মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

খোলা আকাশের নিচে কড়াইল বস্তিবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

খোলা আকাশের নিচে কড়াইল বস্তির সহস্রাধিক মানুষ। খাবার নেই, শীতের কাপড় নেই। সর্বগ্রাসী আগুন কেড়ে নিয়েছে বস্তিবাসীর সব। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বস্তিবাসীর হাহাকারে রীতিমতো ভারী হয়ে আসছে আশপাশের পরিবেশ। রবিবার অগ্নিকাণ্ডের পর গতকাল দুপুরে রাজধানীর মহাখালী এলাকার কড়াইল বস্তিতে গেলে চোখে পড়ে এ দৃশ্য। মেয়র, সংসদ সদস্যসহ এলাকার কাউন্সিলরদের নানামুখী সহযোগিতার আশ্বাসের পরও তারা তেমন একটা সাড়া পাচ্ছেন না বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর। গার্মেন্ট কর্মী আছিয়া খাতুন আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আগুনে আমাগো সব পুইড়্যা ছাই হইছে। অহন পোলাপানরে কই রাখুম, কি খাওয়ামু। দুই দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে রইছি, রুটি কলা আর এক বেলা খিচুরি খাইয়া আছি। এর উপর সারা রাত নির্ঘুম আছিলাম। অহন সাহায্যের অপেক্ষায় আছি।’ তার মতো এক রকম নিদারুণ কষ্টে আছেন সহস্রাধিক অসহায় পরিবার। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রায় পাঁচশ ঘর ও ঘর লাগোয়া দোকানের ছাই সরাতে ব্যস্ত বস্তিবাসী। বসতঘর পুড়ে অসহায় কয়েকশ’ পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে। রবিবার আগুনের খবর পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে খাবারের ব্যবস্থা করতে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন তিনি। স্থানীয় দুই সংসদ সদস্যও ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। এ ছাড়া ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান মফিজও সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এ ছাড়া সরকারদলীয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও খোঁজখবর নিচ্ছেন। তবে গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সহস্রাধিক পরিবার এখনো তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। তারা সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, শিক্ষার্থী পোড়া ঘরের পাশে আহাজারি করছে। তাদের মধ্যে একজনের নাম বাদল মিয়া। তিনি বলেন, আগুনে তার ২০টি ঘর পুরে ছাই হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ঘরে তিনি দুই সন্তান, পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার একটি মুদি দোকানও আগুনে পুড়ে গেছে। সব মিলে তার ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। গতকাল দুপুরে তার সঙ্গে কথা বলার সময় পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃষ্টি নামে এক নারী। তিনি বলেন, ‘যহন আগুন লাগে তহন গার্মেন্টে আছিলাম। রাতে আইয়া দেহি আমার সব পুইরা ছাই হইয়া গ্যাছে।’ তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন সেখানে গার্মেন্টকর্মী মাজেদা আক্তার ও তার স্বামী রিকশাচালক আলম মিয়া দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা জানান, কয়েক বছর ধরে তারা কড়াইল বস্তিতে আছেন। দুই সন্তানকে নিয়ে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। দুজনের পরিশ্রমের টাকায় ঘরে টেলিভিশনসহ কিছু আসবাব করেছিলেন। আগুনে দুই সন্তানের বই খাতা, পোশাকসহ সব পুড়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে তারা এক কাপড়ে রয়েছেন। কথা হয় ইদ্রিস খান নামে ষাটোর্ধ্বো এক ব্যক্তির সঙ্গে। পোড়া ঘরের আসবাবপত্র সরিয়ে পলিথিনের ওপর ছেঁড়া কাঁথা পেরে তিনি বসে আছেন। কাছে এগিয়ে যেতেই বলতে থাকেন আগুনে তার বসতঘরসহ অর্ধলক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তিনি সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি ঢাকাতে। কড়াইল বস্তিতে তিনি ২৫ বছর ধরে আছেন। বস্তিতে তার ৪২টি ঘর রয়েছে। প্রতিটি এক কক্ষের ঘর ভাড়া দিয়ে তিনি ২ হাজার করে ভাড়া পান। এখানে দুটি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়েছে। সেই সঙ্গে ঘরে থাকা লক্ষাধিক নগদ টাকাও পুড়ে গেছে।

তার মতো, সিডি দোকানদার লুত্ফর, ঢালি আক্তার, সকিনা খাতুন, আমেনা বেগম, আরমানসহ আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে বস্তিতেই থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে হারভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকা দিয়ে বাসায় টেলিভিশন, ফ্রিজ আসবাবপত্র করেছিলেন। আগুনে তাদের সব পুড়ে ছাই হয়েছে।

জানা যায়, রাজধানীর সবচেয়ে বড় এ বস্তিতে এর আগে ১৪ মার্চ আগুন লেগে অর্ধশত ঘর পুড়ে যায়, আহত হন দুইজন। গুলশান লেকের দুই তীরে দেড়শ’ একরের বেশি জমির ওপর বিশাল এলাকা নিয়ে এই বস্তির জমির মূল মালিক বাংলাদেশ টেলি-কমিউনিকেশন্স লিমিটেড (বিটিসিএল)। আদালতের আদেশ নিয়ে বিটিসিএল ২০১২ সালে কড়াইলে জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। প্রথম দিনের অভিযানে চার শতাধিক ঘর উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু পরদিন হাজার হাজার বস্তিবাসী গুলশান-মহাখালী এলাকার সড়কে নেমে ওই এলাকা অবরোধ করে রাখে। এতে বন্ধ হয়ে যায় উচ্ছেদ অভিযান।

এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের সময় বস্তিবাসীর অনেক মালামাল চুরি হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনার পর বনানী থানা পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। থানা পুলিশের কর্মকর্তা এসআই মোস্তাক হোসেন বলেন, বরিবার বস্তিতে আগুন লাগার পর থেকে তারা নিরাপত্তার দেখভাল করছেন। তবে ঘটনার সময় অনেকের মালামাল চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এই বস্তি মাদক বিকিকিনি ও অপরাধীদের আখড়া হিসেবেও পরিচিত। এই বস্তিতে অন্তত ৫/৬ লাখ লোক বসবাস করে।

সর্বশেষ খবর