শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নারীদের অবহেলার সুযোগ নেই : প্রধানমন্ত্রী

রোকেয়া পদক পেলেন অ্যারোমা দত্ত ও বেগম নূরজাহান

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারীদের অবহেলার সুযোগ নেই : প্রধানমন্ত্রী

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল রোকেয়া পদকপ্রাপ্তদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের উন্নয়নের জন্য নারীর উন্নয়ন অপরিহার্য। তাই নারীকে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন আমরা নিশ্চিত করতে চাই, যাতে প্রত্যেক নারী অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হয় এবং উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। নিজের সংসার ও সমাজকে যেন গড়ে তুলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম রোকেয়া দিবস ও রোকেয়া পদক-২০১৬ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শতবর্ষ আগের সমাজ বাস্তবতায় বেগম রোকেয়া তখনই বুঝতে পারেন— নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই মুক্তি অর্জন করতে হবে। শিক্ষাই হলো সেই স্বনির্ভরতার সোপান।’ আমরা সব সময় এটাই বিশ্বাস করি যে, শিক্ষা ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্যই শিক্ষার প্রতি আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আগামীতে রোকেয়া পদক দুজনের স্থলে পাঁচজনকে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তেরও উল্লেখ করে বলেন, আগামীতে দুজন নয়, পাঁচজনকে রোকেয়া পদক প্রদান করা হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম। ননঅনুষ্ঠানে নারী উন্নয়নে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আরোমা দত্ত এবং বেগম নূরজাহানকে ‘রোকেয়া পদক ২০১৬’ প্রদান করা হয়। পুরস্কার হিসেবে দুই লাখ টাকার চেক, ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের পদক ও সনদপত্র বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। পুরস্কার প্রদানকালে দুই পদক বিজয়ীর জীবনী পড়ে শোনান মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, পুরস্কারটি আর কিছু নয়, এটি একটি উৎসাহ দেওয়া বা প্রেরণা দেওয়া, একটা সম্মান দেওয়া। কাজেই আজকে যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদেরকে আমি সম্মান জানাচ্ছি এবং আমাদের নারী জাগরণে আপনারা আরও এগিয়ে আসবেন, সেটাই প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন কেবল শহর পর্যায় থেকে নয়, তৃণমূল থেকেই যেন হয়— সেই পদক্ষেপই নিয়েছে তার সরকার। এ জন্য নারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকার করে যাচ্ছে। যেমন— মত্স্য চাষ, কৃষি, হাঁস ও মুরগি পালন, হাউজ কিপিং অ্যান্ড কেয়ার গিভিং, বিউটিফিকেশন, মাশরুম চাষ, রন্ধন প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন, বেসিক কম্পিউটার, আধুনিক গার্মেন্ট, মধুচাষ, লন্ড্রি, অ্যাম্ব্রয়ডারি, ড্রাইভিং, ছোট ছোট যন্ত্রপাতি মেরামতকরণ বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, বেগম রোকেয়ার নিজের লেখা কাব্যগ্রন্থে নারীর মুক্তিতে তার দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। জাগরণের কাজ ‘কঠিন সাধনার’ মন্তব্য করে তিনি লিখেছিলেন— ‘কোন ভালো কাজ অনায়াসে হয় না।’ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে সংরক্ষিত আসনে মহিলা কাউন্সিলর এবং পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করে। দুজন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকতে হবে। উন্নয়নের জন্য যেসব কমিটি হবে সেসব কমিটিরও অন্তত পাঁচটি কমিটিতে নারীরা চেয়ারম্যান থাকবেন। যাতে তারা উন্নয়নের কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী, সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা ও বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী। জাতীয় সংসদের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদই নারীরা দখল করে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হবেন মেয়েরা এটা কেউ কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। যাহোক, আমি উদ্যোগ নেই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী ভিসি-প্রো-ভিসি নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি এবং আছেন, তারা কিন্তু খুব ভালোও করছেন। এমনকি আমরা বুয়েটেও দিয়েছিলাম (নারী ভিসি) কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি হঠাৎ ক্যান্সারে মারা যান।’ বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী প্রো-ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভবিষ্যতেও আরও মহিলাকে দায়িত্ব দেওয়ার ইচ্ছা আছে। কারণ, আমরা দেখেছি মহিলাদের দায়িত্ব দিলেই তারা ভালোভাবে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাতে পারেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগে প্রথম হাইকোর্টের মহিলা জজ আমরা আওয়ামী লীগ সরকারই নিয়োগ দিই। রাষ্ট্রপতিকে বলেই আমি এটা করাই। এখন তো অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত এবং আমাদের সরকারের সময়ই এটা হয়েছে। প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের মেয়েরা অবদান রাখছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যেমন বর্ডার গার্ডে মেয়েদের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। আমাদের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে পূর্বে কিন্তু মেয়েদের কোনো স্থান ছিল না। ’৯৬ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার সেটা শুরু করে। এখন প্রতিটি বাহিনীতেই আমাদের মেয়েরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন এবং আমাদের মেয়েরা কিন্তু ফাইটার প্লেনও চালাচ্ছেন। তারা দুর্গম গিরিশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেছেন। আমাদের মহিলা দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, দাবা ও ফুটবল খেলছে, দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, তথ্য-প্রযুক্তি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, ক্রীড়া জগৎসহ সব চ্যালেঞ্জিং কাজে নারীদের পেশাদারিত্ব প্রশংসনীয়। শেখ হাসিনা বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে তার সরকারের ব্যাপক কার্যক্রমের সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একের পর এক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতার সাড়ে তিন বছরের শাসনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের সরকার দেশে নারী জাগরণে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ এখন নারী উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। সরকারের নারী উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন করেছে। মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ স্ববেতনে ৪ মাস থেকে ৬ মাসে বর্ধিত করা হয়েছে। সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে মায়ের নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৫০ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, ৯ ডিসেম্বর তার মেয়ে  সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্মদিন। তিনি তার মেয়ের জন্য সবার দোয়া চেয়ে বলেন, দোয়া করবেন— সে যা কাজ করে যাচ্ছে তাতে যেন সফল হয়। এদেশের প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক যারা তাদের চিকিৎসাসেবা প্রদান, তাদের জীবনকে অর্থবহ করার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আমি আপনাদের কাছে তাদের জন্যও দোয়া চাই। শেখ হাসিনা বলেন, নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশকে একটি উচ্চ-মাধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব— এটিই হোক রোকেয়া দিবসে আমাদের অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী আলোচনা পর্ব শেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনায় ‘জ্বালাও বহ্নিশিখা’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

সর্বশেষ খবর