বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
কেউ রেহাই পাওয়ার যোগ্য নয় : শিক্ষামন্ত্রী

বিদেশে বই ছাপানোতেই যত বিপত্তি

দেশি ছাপাখানায় কাজ দেওয়ার পক্ষে সংশ্লিষ্টরা, আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কাজ বন্ধের দাবি

আকতারুজ্জামান

বছরের প্রথম দিনে বই উৎসবের আগেই দেশি বেশির ভাগ ছাপাখানা বই সরবরাহ করলেও বিদেশে ছাপা হওয়া বেশির ভাগ বই এখনো স্কুলগুলোয় পৌঁছেনি। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের বই জোগান দেওয়ার জন্য দেশি ছাপাখানা ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক টেন্ডারে ছাপা কাজ বন্ধ করা সময়ের দাবি। এমনকি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তারাও বলছেন, বিশ্বব্যাংকের সব কমপোন্যান্ট চললেও বই কমপোন্যান্ট থেকে তাদের বাইরে রাখা উচিত। তাহলে দেশি ছাপাখানাগুলোই সব কাজ পাবে। আর যথাসময়ে বই পৌঁছে যাবে স্কুলগুলোয়।

শিক্ষাবিদরাও বলছেন একই কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক অনেক কমপোন্যান্ট নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কারণে যদি বইয়ের ছাপা কাজ বাইরে পাঠাতে হয় তাহলে তা মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। মেনে নিলে দেশি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ দেশের ছাপাখানাগুলো এখন অনেক সমৃদ্ধ। এখন হয়তো অল্প বইয়ের কাজ বিদেশে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যে সিংহভাগ বাইরে যাবে না, তা তো বলা যাবে না। তিনি বলেন, বই ছাপানোর কাজ বাইরে দেওয়া সরকারের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।

এদিকে পাঠ্যবইয়ে নানান ভুল আর অসঙ্গতির ঘটনায় গতকাল আরও একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে এনসিটিবির দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়।

সূত্রমতে, প্রাথমিকের বই ছাপাতে মোট ব্যয়ের মাত্র ৯ শতাংশ ঋণ হিসেবে দেয় বিশ্বব্যাংক, যা টাকার অঙ্কে মাত্র ২৬ কোটি। এ টাকা দিতে বিশ্বব্যাংক জুড়ে দেয় নানা শর্তও। এসব শর্ত মানতেই বই ছাপতে হয় আন্তর্জাতিক টেন্ডারে। এ টেন্ডারে অংশ নিয়েই ভারতের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান শীর্ষাসাই যথাসময়ে বই পৌঁছে দেয়নি। ৫৯ লাখ ২১ হাজার ৪১৩টি বই ছাপার কাজ পেলেও প্রতিষ্ঠানটি ৪৭ লাখ বইও সরবরাহ করতে পারেনি। এতে কয়েকটি জেলায় বিঘ্নিত হয়েছে বই উৎসব। বাফার স্টকে থাকা বই দিয়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া হলেও এখন অনেক স্কুলেই শিক্ষার্থীরা সব বই পায়নি। এদিকে রাজধানীর স্কুলগুলোয় চলছে ইংরেজি ভার্সন বইয়ের চরম সংকট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির এক সদস্য গতকাল বলেন, বিশ্বব্যাংক প্রতি পাঁচ বছরের জন্য প্রকল্পে ঋণ দেয়। প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৩ (পিইডিপি)-এর সময়সীমা সম্প্রতি শেষ হয়েছে। পিইডিপি-৪ প্রকল্পে যদি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বইয়ের কমপোন্যান্টে চুক্তি না হয় তবে শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবে, একই সঙ্গে দেশি শিল্প আরও বিকশিত হবে। এনসিটিবিও এ নিয়ে ভাবছে। তবে এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা কিছু বলতে চাই না।’ বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ খান বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পিইডিপি-৪ প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ না হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছি।’ এ নিয়ে শিগগিরই সংবাদ সম্মেলনও করবেন বলে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আরেক কর্মকর্তা বরখাস্ত : পাঠ্যবইয়ে নানান ভুল আর অসঙ্গতির ঘটনায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পর্যালোচনা কমিটির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতেই সোমবার দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। গতকাল এনসিটিবির আরেক কর্মকর্তা সুজাউল আবেদিনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি বোর্ডের আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

পাঠ্য বইয়ের ভুলের জন্য : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, নতুন পাঠ্যবইয়ে ভুলের জন্য দায়ীদের কেউ রেহাই পাবে না। তিনি বলেন, যাদের জন্য এই ভুল তাদের কেউ রেহাই পাওয়ার যোগ্য নয়। ইতিমধ্যে এনসিটিবির তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন দেখে ‘বড় দুটি ভুলের’ জন্য দুজনকে চিহ্নিত করে ওএসডি করা হয়েছে। দোষ প্রমাণিত হলে তাদের পরিপূর্ণ শাস্তি হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিভিন্ন বইয়ে ভুলের কারণে সমালোচনার মুখে গতকাল সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলেন।  নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সবাইকে আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি, যারা এই ভুল করেছেন তারা রেহাই পাওয়ার যোগ্য না। আগেই তাদের ওএসডি করেছি, তদন্ত করে আরও কারা কারা আছেন, কার ভুল, কে কতটুকু দায়ী সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমি এ রকম (ভুল) আশা করি নাই। এখানে পুরোপুরি সব বিষয়ে আলাপ করব না, সেটা সম্ভবও না। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা প্রশ্ন না করলেই খুশি হব। অনেক ভুলত্রুটি হয়েছে, সীমাবদ্ধতা আছে, ত্রুটি থাকতেই পারে। শিক্ষক ঠিক করে দেবেন, যারা দায়ী তারা ঠিক করে দেবেন। এগুলো না করে যদি ঠিক উল্টোটা করতে থাকি, তাহলে ছেলেমেয়েরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি বা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি, ভুলের জন্য আমাদের বিচার হওয়া উচিত, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ছেলেমেয়েদেরকে উৎসাহিত করার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের সবার। যা তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আমি মনে করি তা করা উচিত না। তিনি বলেন, মানুষের ভুলত্রুটি হতেই পারে। আমাদের বেশি হতে পারে, বেশিই হয়তো হচ্ছে, কিন্তু এগুলোই শেষ কথা নয়। তিনি বলেন, কিছু ভুল থাকতে পারে ছাপার ভুল, যেগুলো আমরা সংশোধনী দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতে পারি। কিছু ভুল থাকতে পারে বড় ধরনের ভুল, যেটা সংশোধন করতে গেলে ওই জায়গাটা রিপ্লেস করতে পারি। কিছু ভুল থাকতে পারে যেগুলো থাকা উচিত ছিল না, সেগুলো বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের নির্দেশ পাঠিয়ে দেব। ওই পাতাগুলো আমরা ছিঁড়ে নেব বা ব্লক করে দেব— এভাবে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পাণ্ডুলিপি তৈরির পর তা সম্পাদনা ও মানোন্নয়ন এনসিটিবির দায়িত্ব। বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা এর সঙ্গে জড়িত থাকেন। এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক চূড়ান্তভাবে সই না করলে বই ছাপা হয় না। এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের কিছু শর্তের কারণে প্রাথমিকের বই ছাপাখানায় পাঠাতে দেরি হয়েছে। অল্প সময়ে অতি দ্রুত বইগুলো সম্পাদনার কাজটি শেষ করা হয়েছে। বছরের প্রথম দিন ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ জন শিক্ষার্থীর হাতে এবার ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে সরকার। ছাগলের যে ছবি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে সে বিষয়ে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘দেখা হবে’, ছাগল গাছে উঠে আম খাচ্ছে ফটোশপে তৈরি এমন কিছু ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। ওই ছবি পত্রিকায় ছাপা ঠিক হয়েছে কি না— সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। ‘ও- তে ওড়না’ নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নানা মত থাকতে পারে, আমরা সবগুলো মতামত ওয়েলকাম করি। কিছু ভুল পেয়েছি, যা হওয়া উচিত না। হার্ট বানানে ভুলের বিষয়ে তিনি বলেন, যিনি সম্পাদনা করেছেন তার এটা দেখা উচিত ছিল, এই বিষয়টাকে আমরা ক্ষমা করতে পারি না। শব্দ ও বানান ভুল হতেই পারে, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আদর্শ ছেলে কবিতায় যে ভুল হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পাঠ্যবইয়ের ভুল-ত্রুটির ঘটনায় করা দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আশা করেন এতে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। পাঠ্যবইয়ের কিছু বিষয়বস্তুর পরিবর্তন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দেশ, জাতি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আমাদের চিন্তা সব কিছু বিবেচনায় রেখেই আমাদের তৈরি করতে হয়। তাতে কোনো সময় পাল্লা এদিক-ওদিক হতেই পারে, সমালোচনা থাকতে পারে, আমরা সেগুলোও বিবেচনায় নেই। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন, অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমদ, অরুণা বিশ্বাস ও রুহী রহমান এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের উপ-সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী।

সর্বশেষ খবর