বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাইকেল বালিকা...

সরকার হায়দার

সাইকেল বালিকা...

পরনে কারও স্কুল এবং কারও কলেজের ইউনিফর্ম। কাঁধে ব্যাগ। দুই পায়ে ঘুরছে প্যাডেল। দুরন্ত গতিতে চলছে সাইকেল। একজন নয় দল বেঁধে সাইকেল নিয়ে স্কুল-কলেজে চলছে সাইকেল বালিকারা। আবার একইভাবে বাড়ি ফিরছে শিক্ষার্থীরা। সকাল, দুপুর বা বিকালে পঞ্চগড় শহর ও গ্রামগঞ্জে সর্বত্রই এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। পরিবারেও নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। গত কয়েক বছর আগেও যা ছিল সমাজের নাক ছিটকানোর ব্যাপার, এখন তা নারী অগ্রগতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওদের বলা হয় সাইকেল বালিকা। ওরা সাইকেল চালিয়ে বাড়ি  থেকে প্রতিদিন ৮-১০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে বলে গ্রামের লোকজন ‘সাইকেল বালিকা’ বলেই তাদের চেনে। এসব সাইকেল বালিকা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক কুসংস্কার উপেক্ষা করে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই সাইকেল চালিয়ে জেলা এবং উপজেলা সদরের স্কুলে পড়তে যাচ্ছে। বুকে সাহস আর দল বেঁধে ছুটে চলার আনন্দে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। জীবনে একটা কিছু করে দেখাতে এই স্কুল কলেজ-পড়ুয়া মেয়েদের মনে অনেক স্বপ্ন আর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছে। তেঁতুলিয়া উপজেলার মমিনপাড়া গ্রামের হোটেল শ্রমিক রবিউল আওয়ালের মেয়ে রিফাত জাহান ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বাবা অনেক কষ্ট করে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছেন। সে প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়া-আসা করে সাইকেল চালিয়ে। রিফাত জাহান জানায়, সাইকেলটা না থাকলে অনেক অসুবিধা হতো। কাজী শাহাবুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির  ছাত্রী  জেরিন তাছনিম মুনের বাবা দর্জির কাজ করেন। মুন জানায়, তার বাবাও তাকে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছেন। সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বখাটেরা কিছু বলার সাহস পায় না। একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরজিনা আক্তারের মা দর্জিপাড়া গ্রামের তানজিনা বেগম জানান, মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। আগে অনেকে অনেক কিছুৎ বলত। এখন আর কেউ কিছু বলে না। আমার ভালো লাগে। আগে হেঁটে যেত। ছুটি হলে চোখ মুখ শুকিয়ে বাড়ি ফিরত। রিকশা ভ্যানের ভাড়ার টাকা তো দিতে পারতাম না। এখন আর চিন্তা নেই। টুনিরহাট এলাকার বাসিন্দা নাসরীন আক্তার পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়েই সে ক্লাসে যোগ দেয়। সে জানায়, সাইকেল তাকে অনেক সাহায্য করে। তার দাবি, সময়মতো ক্লাসে উপস্থিত হওয়ার পেছনে রয়েছে এই বাইসাইকেল। ওই কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক এ এইচ এম হাসনুর রশিদ জানান, অনেক শিক্ষার্থী এখন সাইকেল চালিয়ে ক্যাম্পাসে আসে। সাইকেল তাদেরকে নিরাপত্তা আর গতি দিয়েছে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এই জেলার নারীরা। জানা যায়, পঞ্চগড়ে কোনো প্রতিবন্ধকতাই দমাতে পারেনি গ্রামগঞ্জের এই মেয়েদের। গ্রামের ধান ক্ষেতের বুক চিরে কাঁচামাটির রাস্তা বা পিচঢালা পথে প্রতিদিন সকাল-বিকালে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলে কিশোরীর দল। মুখে অমলিন হাসি। বাইসাইকেলের প্যাডেল মেরে বালিকারা এখন ৮-১০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে প্রতিদিন স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। সাইকেল বালিকাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পথে বখাটেদের উৎপাত, যানজট, দুর্ঘটনার আশঙ্কা— এখন কোনোটাই নেই তাদের। বাবা-মাদের দুশ্চিন্তা তারা অনেকটাই লাঘব করতে পেরেছেন। তাদের চোখে মুখে হাসি আর বুকে রঙিন আনন্দ মাখা জীবনের প্রত্যয়। কুয়াশায় মাখানো তীব্র শীত, চৈত্র-বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠের খাঁ খাঁ রোদ, বর্ষায় ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার আলো নিতে প্রতিদিনই তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হয় তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বড় ধরনের অসুখ-বিসুখ ছাড়া তাদের ক্লাস কামাই হয় না আর। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে সার্বিক ও টেকসই উন্নয়ন অর্জনে সব ক্ষেত্রে অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ব্যাপারে কারও সংশয় না থাকলেও পুরুষশাসিত এ সমাজে বৈষম্যহীনভাবে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রবল আত্মবিশ্বাসে কোনো প্রতিবন্ধকতাই এই জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল-কলেজ  পড়ুয়া মেয়েদের দমাতে পারেনি। এটি একটি অভূতপূর্ব ব্যাপার। এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে অন্য জেলাগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর