সোমবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

গাড়ি চুরির যত সিন্ডিকেট

রোধ করা যাচ্ছে না কোনো পদ্ধতিতেই

আলী আজম

১২ ডিসেম্বর পল্লবী থেকে প্রাইভেট কারে ধানমন্ডির ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে যান নুসরাত আরা জাহান। ড্রাইভার ইদ্রিস হাসপাতালের সামনের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হাসপাতালের ভিতরে যান। কিছু সময় পর ফিরে এসে ইদ্রিস গাড়িটি আর দেখতে পাননি। এ ঘটনায় নুসরাতের মা জাহানারা বেগম ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেন। ৪ সেপ্টেম্বর পল্টন থেকে একটি এক্সিও গাড়ি রাজবাড়ী যাওয়ার জন্য ৬ হাজার টাকায় ভাড়া নেন এক ব্যক্তি। ভাড়া নেওয়ার পর গাড়িতে ওঠেন আরও ৩/৪ জন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে রাত পৌনে ১১টায় মোহাম্মদপুর ভাঙ্গা মসজিদের পাশে গাড়িটি থামাতে বলেন। যাত্রীরা গাড়ি থেকে নেমে কৌশলে আখের রসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিলিয়ে ড্রাইভারকে খাওয়ায়। ড্রাইভার জ্ঞান হারালে তাকে ফেলে রেখে গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যায় যাত্রীবেশী দুর্বৃত্তরা। রাজধানীতে নানা কায়দায় নিত্যনতুন কৌশলে প্রতিদিনই গাড়ি চুরি হচ্ছে। ট্র্যাকিং পদ্ধতি থাকলেও গাড়ি চুরি থেমে নেই। মাঝেমধ্যে গাড়ি চোর চক্রের কিছু সদস্য গ্রেফতার হলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, প্রতি মাসে গড়ে শতাধিক গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটছে। তবে থানায় অভিযোগের সংখ্যা কম। গেল বছরে থানায় অভিযোগ এসেছে মাত্র ৫৮২টি। অথচ গাড়ি উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ১৬৬টি। অনেকেই হয়রানির ভয়ে থানায় অভিযোগ করেন না। চুরি যাওয়া এসব গাড়িই বিভিন্ন সময় মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহূত হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীতে অর্ধশতাধিক গাড়ি চোর চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব চক্রের সদস্য রয়েছে পাঁচ শতাধিক। পল্টন, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, বিমানবন্দর, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় গাড়ি চোর সিন্ডিকেট সদস্যের বড় বড় চক্র রয়েছে। আর এসব স্থান থেকে সারা দেশে গাড়ি চোর চক্রের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে অধিকাংশ চুরির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা থানায় মামলা কিংবা জিডি করেন না। ফলে গাড়ি চুরির প্রকৃত পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয় না। সূত্র জানায়, গাড়ি চুরির পরপরই তা বিক্রির জন্য বিভিন্ন হাতবদল হয়ে ঢাকায় বা মফস্বলে চলে যাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ গাড়ি বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে। বিভিন্ন মহল্লায় পুরনো গাড়ি বিক্রির পোস্টার লাগিয়ে এবং গাড়ির এজেন্টদের যোগসাজশে গাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে। গাড়ি চুরি চক্রের সদস্যরা গাড়িটি হুবহু বা গাড়ির রং পাল্টে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিশ্বস্ততা অর্জনে তৈরি করা হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন নম্বর, গাড়ি নম্বরসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাগজপত্র। এসব কাগজপত্র অরিজিনাল মনে হলেও সবই নকল। এমনকি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনও পাল্টে ফেলা হচ্ছে। খুব কাছ থেকে না দেখলে এটা ধরা মুশকিল। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, আগে চুরি করার পর গাড়ির বিভিন্ন ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ পাল্টানো হতো। বিশেষ করে নতুন চেসিস লাগানো হতো। এমনকি গাড়িতে নতুন করে রং করতে হতো। এতে চোরাই গাড়ি বাজারজাত করতে তাদের প্রচুর টাকা খরচ হতো। কিন্তু এখন গাড়ির যন্ত্রাংশ এমনকি চেসিস ও রং আর পরিবর্তন করতে হয় না। এসবের মূলে রয়েছে তাদের আধুনিক প্রযুক্তির পাঞ্চিং মেশিন। পাঞ্চিং মেশিন দিয়ে গাড়ির চেসিস নম্বর তুলে নতুন চেসিস নম্বর বসিয়ে কাগজপত্র তৈরি এবং পরে তা বিক্রি করা হচ্ছে।

ওই কর্মকর্তার মতে, রাজধানীতে কয়েকটি কৌশলে গাড়ি ছিনতাই বা চুরি হচ্ছে। চালকের ছদ্মবেশে হরদম গাড়ি ছিনতাই হচ্ছে। চালক পদে নিয়োগের সময় মালিকের কাছে তারা ভুয়া নাম, ঠিকানা ও কাগজপত্র জমা দেয়। পরে গাড়ির নকল চাবি বানিয়ে নিচ্ছে। একপর্যায়ে তারা গাড়ি চুরি করে চলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চালকরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে গাড়িটি নজরে রাখে। সুযোগ বুঝে বানানো চাবি দিয়ে গাড়ি চুরি করছে। এরা বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল, হাসপাতাল ও রেস্টুরেন্টের মতো ব্যস্ততম এলাকায় ওঁৎ পেতে থাকে। ছিনতাইয়ের অন্য গ্রুপ একটি মাস্টার চাবি ব্যবহার করে। এ ছিনতাই চক্রে থাকে চার-পাঁচজন সদস্য। একজন মাস্টার চাবি দিয়ে গাড়ির লক খুলতে থাকে। অন্যরা অনুসরণ করে গাড়ির মালিক কিংবা চালককে। অল্প সময়ের মধ্যেই ছিনতাই চক্র লক খুলে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। আরেকটি গ্রুপ মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট কারে যাত্রী বেশে চড়ে কৌশলে গাড়ির ড্রাইভারকে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে, মারধর বা গুলি করে হত্যা করে গাড়ি নিয়ে পালাচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (উত্তর) নিশাত রহমান মিথুন বলেন, রাজধানীতে বেশ কয়েকটি গাড়ি চুরি চক্র সক্রিয় রয়েছে। চুরির ক্ষেত্রে তারা নিত্য-নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চক্রগুলো মাস্টার চাবি দিয়ে গাড়ি চুরি করছে। অনেক সময় ড্রাইভার সেজে, যাত্রী বেশে বা এসিড দিয়ে গাড়ির লক খুলেও গাড়ি চুরি করা হয়। গাড়ি চুরি নিয়ে কাজ করছেন গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, গাড়ি চুরি চক্রের সদস্যদের বেশ কয়েকটি গ্যারেজ মালিক সহযোগিতা করে। অনেক সময় গাড়ি চুরি করে বিভিন্ন বাসার ভালো কার পার্কিং ভাড়া নিয়ে গাড়ি রাখা হচ্ছে। গাড়ি চুরির পর বিশ্বস্ততা অর্জনে অরিজিনাল কাগজপত্রের মতো হুবহু কাগজপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। অনেক সময় রং, নম্বরসহ পাল্টে ফেলা হচ্ছে চেচিস নম্বরও। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে এ চক্রের সদস্যরা বেশির ভাগ গাড়ি বিক্রি করছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যে গাড়ি চুরি করে সে সরাসরি ভোক্তাকে দেয় না। কয়েকটি হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে যাচ্ছে। রাজধানীসহ জেলা ও থানা পর্যায়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম দামে গাড়ি কিনতে আগ্রহীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব গাড়ি মাদক ও ছিনতাই কাজেও ব্যবহূত হচ্ছে। তবে ড্রাইভারদের অসতর্কতার কারণেই বেশির ভাগ গাড়ি চুরি হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দফতর সূত্র বলছে, গেল বছরে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গাড়ি চুরির ঘটনায় ৫৮২টি মামলা হয়েছে। তবে বিভিন্ন অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ১৬৬টি গাড়ি। এর মধ্যে রয়েছে ৫৪টি ট্রাক/কভার্ড ভ্যান, ৬৮টি মাইক্রোবাস, ৩১২টি প্রাইভেট কার, ৫০টি জিপ/পিকআপ, ২১৪টি অটো রিকশা/সিএনজি, ৪৪৩টি মোটরসাইকেল, ২০টি বাস ও পাঁচটি ট্যাক্সি ক্যাব।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর