বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

কালোন্দি খালে ‘কালো পানি’

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও মোশাররফ হোসেন বেলাল, আখাউড়া থেকে ফিরে

কালোন্দি খালে ‘কালো পানি’

সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর আখাউড়া। আর এই আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশি নানা পণ্য। আর এতে আয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। কিন্তু এই স্থলবন্দর ঘেঁষে দুই দেশের সংযোগে বয়ে গেছে একটি ছোট খাল। এ খালের নাম কালোন্দি। আবার কেউ কেউ বলছেন, এর নাম জাজি নদী। দেশের এ স্থলবন্দর যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে, ঠিক এর উল্টো এই কালোন্দি খাল। কারণ কালোন্দি খালে ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে আসছে ‘কালো পানি’। আর এই কালো পানি আখাউড়া স্থলবন্দর ও আশপাশ এলাকার মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খালের পানি দেখে কেউ বুঝবেন না এটি সাধারণ পানি। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে আসা ময়লা-আবর্জনা ও রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত এই কালো পানির কারণে এখন ধ্বংসের মুখে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও রয়েছেন সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত হাজার হাজার মানুষ। তবে অস্বাস্থ্যকর ঝুঁকিপূর্ণ এই কালো পানি নিয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অবশ্য কয়েক দফায় দুই দেশের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হলেও রহস্যজনক কারণে বন্ধ হচ্ছে না এ কালো পানি। ফলে সীমান্ত এলাকা আখাউড়ার মানুষের চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্ট যেন লেগেই আছে। জানা যায়, আগরতলা থেকে প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর-সংলগ্ন কালোন্দি লেক দিয়ে বাংলাদেশে আসছে ময়লা কালো পানি। আগরতলা এলাকায় অবস্থিত ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ডাইং, চামড়া ও মেলামাইন কারখানা এবং বিভিন্ন বাসা-বাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনের পানি প্রবেশ করছে এখানে। বছরের পর বছর ধরে আসা এই কালো পানির কারণে ধ্বংস হচ্ছে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী ১৫টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে বহুবার অভিযোগ জানিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আখাউড়া স্থলবন্দরের যে সড়কটি ইমিগ্রেশন পার হয়েছে, এর উত্তর পাশ ঘেঁষে একটি ছোট খাল বয়ে গেছে, যা দুই দেশের মধ্যে অনেকটা পানি আদান-প্রদানের পথ। আর এই খাল দিয়েই প্রতিনিয়ত ভারত থেকে পচা, দুর্গন্ধযুক্ত পানি সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। কিন্তু এটি যেন দেখার কেউ নেই। দেখা গেছে, এ খালের পানি দিয়ে আশপাশের আবাদি জমিতে সেচ দিচ্ছেন চাষিরা। তবে এ পানি শরীরে লাগলেই চুলকায় বলে জানান তারা। শুধু তা-ই নয়, এই পানির কারণে আশপাশের এলাকার মানুষ চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। খালঘেঁষা মেসার্স মা-মনি এন্টারপ্রাইজের মালিক ইলিয়াছ মিয়া বলেন, ‘ময়লা পানির দুর্গন্ধে এখানে টেকা সম্ভব হচ্ছে না।’ আখাউড়া স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নিছার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, এ খাল দুই দেশের মধ্যে বয়ে আনবে সৌন্দর্য। অথচ এটি এখন আখাউড়ার মানুষের অভিশাপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজিবি সদস্য জানান, বিজিবি ক্যাম্পটি কালোন্দি খাল-সংলগ্ন হওয়ায় বিষাক্ত পানির প্রভাবে তাদের অনেক সদস্যের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে চুলকানির প্রকোপ বাড়ছে। সীমান্তবর্তী এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, আগরতলার বর্জ্যযুক্ত বিষাক্ত কালো পানির প্রভাবে তারা অনেকেই শ্বাসকষ্ট, চুলকানিসহ নানা রোগে ভুগছেন। এ নিয়ে প্রশাসনের কাছে একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোসাদ্দেক হোসেন মো. রাজীব বলেন, বিষয়টি ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘আমরা একাধিকবার কালোন্দি খাল দিয়ে কালো পানি বন্ধের জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে, দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের জন্য এটিপি প্লান্ট (এয়ার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন করা হবে। এটিপি প্লান্ট স্থাপন করা হলে বিষাক্ত এই কালো পানি আর বাংলাদেশে প্রবেশ করবে না।’

সর্বশেষ খবর