সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

গাড়ির সিলিন্ডার যখন ভয়ঙ্কর

নকল ভেজাল নিম্নমানের গ্যাসে দেশ সয়লাব, ৪০০ বিস্ফোরণে নিহত ২৫০

সাঈদুর রহমান রিমন

গাড়ির সিলিন্ডার যখন ভয়ঙ্কর

দেশে গত ছয় বছরে চারশটিরও বেশি সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় আড়াইশ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনায় দেড় শতাধিক গাড়ি ভস্মীভূত হয়েছে, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও প্রায় তিনশ গাড়ি। বিআরটিএ ও আরপিজিসিএল সূত্র জানায়, ত্রুটিপূর্ণ, নিম্নমানের সিএনজি সিলিন্ডারের কারণে থামছেই না গাড়ির বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা। সিএনজিচালিত যানবাহন বিস্ফোরণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ছে না কোনো মহলেরই। উপযোগী আইন না থাকায় কার্যকর ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। ঝুঁকির মাঝেই চলতে হচ্ছে যাত্রীদের।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে সিএনজিচালিত গাড়িতে ব্যবহৃত সিলিন্ডারের প্রায় ৮৮ শতাংশই রিটেস্টের মেয়াদোত্তীর্ণ। রাজধানীসহ দেশব্যাপী বৈধ ও অনুমোদিত সিএনজি কনভার্সন সেন্টার রয়েছে ১৮০টি। এসব যানবাহনের জন্য সারা দেশে ৫৮৭টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। সিএনজিচালিত এসব গাড়ির রিটেস্ট করার জন্য কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ১১টি। এত কম সংখ্যক কেন্দ্রের পক্ষে কিছুতেই ২ লাখ ৯৮ হাজার গাড়ির সিলিন্ডার রিটেস্ট করা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত মাত্র ৫৪ হাজার সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্টিং করা হয়েছে, যা মোট সিলিন্ডারের মাত্র ১২ ভাগ।

বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে গাড়িতে সংযোজিত আড়াই লক্ষাধিক সিএনজি সিলিন্ডার এখন জানমালের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে চলন্ত অবস্থায় প্রায়ই গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হচ্ছে, দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে যানবাহন। প্রাণহানিও ঘটছে অহরহ। বৈধভাবে সংযোজিত দুই লক্ষাধিক সিলিন্ডার এরই মধ্যে রিটেস্টের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে আছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নকল-ভেজাল নিম্নমানের অসংখ্য সিলিন্ডার। রিটেস্টবিহীন সিলিন্ডারগুলো চরম ঝুঁকি সত্ত্বেও বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কারে হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ, ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে    প্রায়ই দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারযুক্ত গাড়ি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে তা শক্তিশালী বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর। প্রতিটি গাড়ির সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা, সিএনজি সিস্টেম পরীক্ষা, সিএনজি ফিলিং স্টেশনের বার্ষিক নিরাপত্তা জরিপ আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হলেও তা যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। সম্প্রতি রাজধানীসহ সাভার, মানিকগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রামে যে কয়টা বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটেছে, প্রত্যেকটিতেই দেখা গেছে ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার। এসব সিলিন্ডারে ছিল না কোনো সেফটি সিস্টেম। অপেক্ষাকৃত কম দামে ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার সংগ্রহ করে নিজেদের গাড়িতে সংযোজন করছেন অনেকেই। ইদানীং পুরনো জাহাজের মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারকেও সিএনজি সিলিন্ডার হিসেবে গাড়িতে সংযোজনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব সিলিন্ডারে দীর্ঘদিন গ্যাস জমে থাকায় এর চাপ নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন শিপইয়ার্ড থেকে একশ্রেণির গাড়িচালক কম টাকায় এ সিলিন্ডার কিনে গাড়িতে প্রতিস্থাপন করায় তা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রকৌশলীরা জানান, সিলিন্ডার কনভার্সনের সময় হাইপ্রেশার, শাটার, সুইচ মিটার ওয়েরিং, ক্লাম্প, ক্লিপ ও টাইনিং রিলে লাগাতে হয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে এগুলোর কোনোটি বিচ্যুতি হলেই তা সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি কোনো সংস্থাও গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার তদারকির দায়িত্ব নিতে চাইছে না। গ্যাস সিলিন্ডারের বিষয়াদি নিয়ে সংশ্লিষ্ট রূপান্তরিত গ্যাস কোম্পানি লি. (আরপিজিসিএল), বিআরটিএ ও বিস্ফোরক অধিদফতর একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েই খালাস। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের হাজার হাজার গাড়ি রীতিমতো ‘ভয়ঙ্কর ঝুঁকি হয়ে’ প্রতিনিয়ত রাস্তায় চলাচল করছে। তবে আরপিজিসিএল সূত্র জানিয়েছে, বিআরটিএ, বিস্ফোরক অধিদফতর ও আরপিজিসিএল কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদারকি কমিটি গঠিত হয়েছে। গাড়ির সিএনজিতে রূপান্তরের অনুমোদনসহ যাবতীয় বিষয় ওই কমিটির পক্ষ থেকে তদারকি করার কথা রয়েছে। কিন্তু তিন সদস্যের তদারক কমিটির মধ্যেই কোনোরকম সমন্বয় গড়ে ওঠেনি।

সর্বশেষ খবর