নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে নদীপথে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঠেঙ্গার চরকে মানববসতির উপযোগী বলে প্রতিবেদন দিয়েছে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও সহকারী বন সংরক্ষকের নেতৃত্বে দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল সরেজমিনে ঠেঙ্গার চর পরিদর্শন শেষে এই প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে ঠেঙ্গার চরে মানববসতির জন্য শক্ত বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস। রোহিঙ্গাদের এই চরে এনে পুনর্বাসন করার আগে বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ ক্যাম্প করা দরকার বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ২০ বছর আগে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এই চর প্রথমে জাইল্লার চর (জেলের চর), এরপর কেম্বার চর (কাঁকড়ার চর) এবং সর্বশেষ ঠেঙ্গার চর বলে পরিচিতি পায়। এর আগে বন বিভাগের নলচিরা রেঞ্জ কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন ভূঞা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে চরটি ‘মানববসতির উপযোগী নয়’ বলে উল্লেখ করেন। এর কারণ হিসেবে সেখানে পানীয় জলের উৎস না থাকা, জোয়ার-ভাটায় ঢুকে যাওয়া, অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানটি এখনো স্থায়িত্ব না হওয়া ও পাড় থেকে নিয়ে নিচু স্থানে যেতে হাঁটু পরিমাণ কাদা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা উল্লেখ করা হয়। মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর ঠেঙ্গার চরে পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের পর চরটি জনবসতির উপযোগী কিনা নানা মহলে সে বিতর্ক ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসনকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এরপর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুব্রত কুমার দে ও সহকারী বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে দুই সসস্যের প্রতিনিধি দল সরেজমিনে ঠেঙ্গার চর পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে নদীপথে আনুমানিক ২০ কিলোমিটার দূরে ঠেঙ্গার চরের অবস্থান। মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এই চরটির আয়তন জোয়ারের সময় ১০ হাজার একর এবং ভাটার সময় ১৫ হাজার একর। ২০১০-১১ সালে সরকারিভাবে চরে বনায়ন শুরু হয়। অনুকূল পরিবেশ না থাকায় জনমানবহীন চরটি এখন মূলত গরু-মহিষের চারণভূমি হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। তবে হাতিয়ার অন্য চরগুলোর মতো ঠেঙ্গার চরকে জনবসতির উপযোগী করে তুলতে হলে এখানে শক্ত বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে সুপারিশ করে জেলা প্রশাসন। চরটি ঘুরে এসে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুব্রত কুমার দে বলেন, ‘পরিদর্শনকালে আমরা ভরা জোয়ারের সময় পানির স্তর থেকে অন্তত ৪ ফুট উঁচুতে চরটি দেখে এসেছি। বনের গাছগুলোও বেশ পোক্ত হয়েছে। আনুষঙ্গিক অবকাঠামো করা হলে এখানে জনবসতি স্থাপনে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করছি না। শুধু ঠেঙ্গার চর নয়, যে কোনো চরেই জনবসতির জন্য বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, সুপেয় পানি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকাটা জরুরি।’ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতায় জোয়ারের সময় বেড়ির বাইরে থাকা হাতিয়ার যে কোনো চরেই পানি প্রবেশ করে বলে উল্লেখ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। ঠেঙ্গার চর এর ব্যতিক্রম কিছু নয় বলে যোগ করেন তিনি। এ ব্যাপারে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস জানান, সরকার ২০১৪ সালের শেষ দিকে নোয়াখালীর চরে রোহিঙ্গাদের জায়গা দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে প্রস্তাব পাঠাতে বলে। তখন ঠেঙ্গার চরের ৫০০ একর জায়গা প্রস্তাব করা হয়। এবারের সুপারিশেও ঠেঙ্গার চরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে মত দেওয়া হয়েছে। লোকালয় থেকে দূরে চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হলে তাদের পক্ষে অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা কম বলে মত দেন জেলা প্রশাসক। হাতিয়ার এমপি আয়েশা ফেরদৌস মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠেঙ্গার চরে পুনর্বাসনের বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, পানীয় জলের ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত ক্যাম্পসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে এই চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে অসুবিধার কিছু নেই। চরটিতে আশ্রিতদের মত্স্য ও কৃষিভিত্তিক জীবিকায়নের ব্যবস্থা করা হলে রোহিঙ্গারা অপরাধজগৎ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে বলে মত দেন তিনি।