বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

চিঠিগুলো শেখ হাসিনাকে দিতে চান ফিরোজা বেগম

মাহবুবুল হক পোলেন, মেহেরপুর

গাংনী শহরের ৭০ বছর বয়সী ফিরোজা বেগমকে তার স্বামী মহামূল্য একটি ‘মানিকরতন’ দিয়ে গেছেন। ৯         বছর ধরে তিনি এই মানিকরতন আগলে রেখেছেন। এখন তিনি এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চান। তার স্বামী আবুল খয়ের চান্দু মারা গেছেন ২০০৮ সালে। চান্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুজপ্রতিম সহচর। বঙ্গবন্ধু কারাবন্দী থাকা অবস্থায় তাকে চিঠি লিখতেন চান্দু। জবাবে বঙ্গবন্ধুও চিঠি দিতেন। এ রকম অনেক চিঠির একটি এখন অটুট রয়েছে। ফিরোজা বেগমের ভাষায় এ এক মহামূল্য মানিকরতন। তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে মোটামুটি ভালোই আছি। কারও কাছে কিছু চাওয়ার নেই। একটাই শুধু চাওয়া— বঙ্গবন্ধুর মেয়ের হাতে তার চিঠিখানি তুলে দিয়ে আনন্দ পাওয়া।’ আবুল খয়ের চান্দুর মামা ছিলেন আকরামুল হক। ১৯৪৭-পূর্ববর্তী সময়ে আকরাম ছিলেন অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের নেতা এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নেয়ামত’-এর সম্পাদক। ভারত বিভাগের পর আকরামুল হক তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের বড়বাড়িয়ায় চলে আসেন। সেখানে তিনি স্থানীয় একটি হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন। এ সময় যুবক শেখ মুজিব প্রায়ই বড়বাড়িয়া গ্রামে আকরামুল হকের কাছে আসতেন। দুজনের মধ্যে অনেক রাজনৈতিক আলাপ হতো। সেসব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন চান্দু। যতই শুনতেন ততই শেখ মুজিবের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হতেন। এ ছাড়া গোপালগঞ্জের সীতানাথ একাডেমিতে শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসেরের সহপাঠী চান্দু। চান্দুকে ছোট ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতেন শেখ মুজিব। চান্দুদের বাড়ি গোপালগঞ্জ শহর আর টুঙ্গিপাড়ার মধ্যবর্তী পারকুশীল গামে। গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গিপাড়ায় যাতায়াতের সময় বঙ্গবন্ধু প্রায়ই পারকুশীলে চান্দুর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ফিরোজা বেগম স্বামীর মুখে শুনেছেন : ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পরে আওয়ামী লীগ গোপালগঞ্জ শহরে বিরাট এক জনসভার আয়োজন করে। এ সভা ভণ্ডুল করার জন্য মুসলিগ লীগ সরকার জারি করে ১৪৪ ধারা। শেখ মুজিব ভঙ্গ করে মধুমতির বালুচরে (এখন সেখানে গার্লস হাইস্কুল ভবন হয়েছে) লোকজন নিয়ে জনসভা শুরু করলেন। জনসভার কর্মীদের মধ্যে চান্দুও ছিলেন। হাজার হাজার মানুষ বালু আর পানিতে দাঁড়িয়ে ‘টুঙ্গিপাড়ার মুজিবর মিয়ার’ ভাষণ শুনেছেন। শাসকরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে মুজিব এবং আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সে সময় আবুল খয়ের চান্দু থাকতেন গোপালগঞ্জ আনসার লাইব্রেরির পেছনে আলতাব হোসেন খানের বাড়ির একটি ঘরে। জনসভাস্থল থেকে পালিয়ে চান্দু রাতে তার ঘরে ফিরে এসে দেখেন মুজিব ভাই ও জালাল উদ্দীন মোল্লা সেই ঘরে আত্মগোপন করে আছেন। এই ঘর থেকেই তিনি আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। এই সময়ে চান্দু-মুজিব ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

১৯৬৯ সালের নভেম্বরে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে চান্দু বেশকিছু চিঠি লিখেছিলেন। সবকটিরই উত্তর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ওসব চিঠি চান্দু ‘মহামূল্য মানিকরতন’-এর মতই সযতনে রেখে দিয়েছিলেন। অনেক চিঠি নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকটি হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি চিঠিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—

‘স্নেহের চান্দু

আমার দোয়া ও ভালবাসা নিও। তোমার চিঠি পেয়ে খুব আনন্দিত হলাম। বাড়িতে কেন বসে আছো! আমার চিন্তা করিও না। অদৃষ্টে যা আছে তা হবেই। দেশকে ভালবাসলে কষ্ট সহ্য করতে হয়। মৌলবী সাহেব ও সকলকে আমার সালাম দিও। কোনমতে দিন কেটে যাচ্ছে। কতদিন থাকতে হয় ঠিক কি! দুঃখের পথ যে বেছে নিয়েছে তার আবার দুঃখ কিসের? ভয় নাই। খোদা সহায় আছেন। অন্যায় করি নাই। আমার কথা ভুলতে চেষ্টা কর। তোমরা সবাই সুখে থাক এই আশীর্বাদ করি। খোদা হাফেজ। তোমার ভাইজান মুজিব।’

আবুল খয়ের চান্দু চাকরির সুবাদে মেহেরপুরের গাংনীতে এসেছিলেন। দীর্ঘদিন এখানে পাটবীজ পরিদর্শক পদে বহাল ছিলেন। ১৯৯৪ সালে অবসরে যান। অবসরের পরও আর ফিরে যাননি গোপালগঞ্জে। এখানকার মানুষের মায়ার টানে থেকে গেছেন। শেষ নিঃশ্বাস ছেড়েছেন এই গাংনীতেই। গাংনী শহরের কুষ্টিয়া-মেহেরপুর সড়কের পাশে বাড়িতে তিন ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে বাস করেন চান্দুর সহধর্মিণী ফিরোজা বেগম। বড় মেয়ে ফরিদা ইয়াসমিন স্বপ্না স্কুলশিক্ষক, তিনি গাংনী মহিলা আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী। জামাতা শহিদুল ইসলাম গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক। বড় ছেলে আবদুল কাদের ব্যবসায়ী। অন্য দুই ছেলে শ্যামল ও চঞ্চল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বয়সের ভারে নুব্জ ফিরোজা বেগম ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনি নিয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাড়িতে প্রতিদিন কেউ না কেউ আসে বঙ্গবন্ধুর এ চিঠিটি একনজর দেখার জন্য। এ চিঠি দেখাতে তার কোনো বিরক্তিবোধ নেই। প্রতিদিন বিকালে তিনি দর্শনার্থীদের জন্য চিঠিখানি সযতনে একটি টেবিলের ওপর সাজিয়ে বসে থাকেন।

সর্বশেষ খবর