বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ রোধ মূল চ্যালেঞ্জ

নারী দিবসে বাংলাদেশ প্রতিদিন গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ রোধ মূল চ্যালেঞ্জ

নারীদের সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে তাদের শিক্ষা, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি জোর দিতে হবে। বর্তমান সরকারের মূল চ্যালেঞ্জই নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিয়ে রোধ করা। এখনো কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে নারীর চেয়ে পুরুষদের প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়। তবে নারীরা কেবল যে হাতাশা ও বঞ্চনার মধ্যেই আছেন এমন নয়, তাদের কিছু আলোর কথাও আছে। আর সব ক্ষেত্রে বিচরণ করলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ এখনো কম। তাই নারীদের জন্য এখন আর সমঅধিকার নয়, বরং অগ্রাধিকার চাই। এমন কথাই বললেন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিনের গোলটেবিলে বক্তারা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া লিমিটেডের কনফারেন্স রুমে গতকাল আয়োজিত এ গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।  ‘পরিবর্তনের জন্য আত্মবিশ্বাসী হও’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং নিউজ টোয়েন্টিফোরের এডিটর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সামিয়া রহমান। অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য, চিকিৎসক, শিক্ষক, উদ্যোক্তা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক ও আইনজীবীসহ সমাজে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন নারী-পুরুষরা অংশ নেন।   মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি তার বক্তব্যে বলেন, ‘নারী দিবসকে কেন্দ্র করে দিন দিন আয়োজন বাড়ছে। শুধু সরকারি উদ্যোগেই নয়, বেসরকারি উদ্যোগেও এখন নারী দিবস পালিত হচ্ছে। এমনকি মিডিয়াও এখন নারীর অগ্রযাত্রায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করছে। বাহাত্তরের সংবিধানেও নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। নারীদের সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে তাদের শিক্ষা, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ সহিংসতা ও বাল্যবিয়ে রোধ করা। খাদিজা হত্যাচেষ্টার রায় দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অন্যান্য মামলার রায়ও দ্রুত দেওয়া হবে। প্রযুক্তির কারণে এখন নারীর প্রতি সহিংসতা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি কঠিন আইন। এর সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সমাজে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা থাকতেই পারে। আর সে বিষয়টি মাথায় রেখেই বিয়ের জন্য বিশেষ ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা যে এবার বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য মাঠে নেমেছি, তাতে আশা করছি দুই বছরের মধ্যে বাল্যবিয়ে অর্ধেকে নামাতে সক্ষম হব।’ সাবেক হুইপ ও সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, নারীকে ক্ষমতায়িত করতে প্রশিক্ষিত করতে হবে। মর্যাদা বোধ শেখাতে হবে। মেয়েদের দমন করার জন্য ‘স্ক্যান্ডাল’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। সংরক্ষিত মহিলা আসনের নূরজাহান বেগম মুক্তা এমপি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গসমতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, সংসদেও নারীরা কথা বলার সুযোগ কম পান। কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, সমাজের সাইকেলে দুটি চাকা লাগানো আছে। এর একটি চাকা নারী ও অন্যটি পুরুষ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, নারী যদি আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী ও দৃঢ় থাকে, তবে তার চলার পথে আর বাধা আসবে না। নারীরা জিডিপিতেও বড় অবদান রাখছেন। প্রতিযোগিতার স্থান থেকে নারীরা পুরুষদের থেকে এগিয়ে গেলে তাদের নির্ভরশীলতাও কমবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমার পৃথিবীজুড়ে আছে আমার মা, স্ত্রী এবং কন্যা। আর তিন নারীই আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, জন্মের সময় ছেলে-মেয়ে উভয়ে একই আত্মবিশ্বাস নিয়ে জন্মায়। কেউ কম কেউ বেশি না। কিন্তু মেয়ে যখন আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে, তখন তার হাতে-পায়ে পরিয়ে দেওয়া হয় শিকল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু বলেন, ‘নারী ঘরে বসে না থেকে যদি নিজ গৃহেই কৃষিসহ মৎস্য উৎপাদন করে, তবে এতে শারীরিকভাবেও সে সুস্থ থাকবে। আমার কাছে এমন অনেক রোগী আসেন, যাদের ঘরে অলস বসে থাকার ফলে কোমরে ব্যথা ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়।’ বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক ও পূর্ব-পশ্চিম ডট কম সম্পাদক খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন বলেন, ‘এ কথা সত্য যে আমরা এখনো কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে নারী কর্মীর চেয়ে পুরুষদের প্রাধান্য দিই। কারণ নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হয়।’ নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী বলেন, মেয়েরা সাহসের সঙ্গে সাংবাদিকতা করছেন এ কথা সত্য। নারীকে তার পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে বেশি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পরিশ্রম বেশি করতে হয়। নারী উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ ওমেন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাসরিন ফাতিমা আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘আমাদের অনেক উদ্যোক্তা আছেন, যারা ঢাকার বাইরে থাকেন। আর্থিক লেনদেনের জন্য তাদের প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার শিকার হতে হয়। কিন্তু প্রয়োজনের খাতিরেই এখন তাদের ঘরের বাইরে বের হতে হচ্ছে।’ মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, নারী যদি আত্মবিশ্বাসী না হয় তবে কোনো কাজেই সফলতা আসবে না। প্রতিনিয়ত তার কাজে বাধা আসবে। মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বিশেষ বিধান রেখে যদি একজন কিশোরীকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে করাতে হয়, তবে সে বিষয়ে এখনই চিন্তা করা উচিত। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, দুঃখজনক যে, দেশের ৭২ শতাংশ নারী ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েও এ কথা লুকিয়ে রাখছেন। সময় এসেছে এখন নারীদের ভেতরের বাধাগুলো দূর করতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিডনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সহেলী আহমেদ সুইটি বলেন, ‘কিডনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলাদেশে নারীর সংখ্যা খুব কম। এ জন্য অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু শুধু নারী হওয়ায় আমাকে একটি অ্যাসোসিয়েশনে বক্তব্য দিতে ডাকা হয় না। কিংবা নারীরা একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করায় সে ফাউন্ডেশনকেও সদস্য করে না ওই অ্যাসোসিয়েশন। প্রমোশন পেতেও মেয়েরা বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের শুনতে হয় আপত্তিকর কথা।’ জাতীয় মানসিক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারজানা রহমান বলেন, গঠনগতভাবে বৈজ্ঞানিক বৈচিত্র্যের কারণে নারী অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়। প্রাকৃতিকভাবেও বেশি কষ্ট নিতে পারে। সাধারণত সমাজের স্বামীপরিত্যক্তা, বিধবা ও অসহায় নারীরাই বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওয়াবেদ বলেন, নারীরা সব ক্ষেত্রে বিচরণ করছে কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তাদের অংশগ্রহণ কম। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচন করে এমপি হওয়া নারীর সংখ্যাও খুব কম। নারীরা নিজেদের যোগ্যতাবলে বাধা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরই আবার বাধার সম্মুখীন হন।

চলচ্চিত্র পরিচালক নার্গিস আক্তার বলেন, ‘অনেকে বলে নারী বস্ হলেও তাকেও ডমিনেটেড হতে হয়। আমার মনে হয় ব্যাপারটা তা নয়। একজন বস্ ঠিক করবে সে কীভাবে তার টিম চালাবে। আমার টিমে সাতজন নারী সহকর্মীকে যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি দিয়েছিলাম, তেমনই পুরুষ সহকর্মীকেও পিতৃত্বকালীন ছুটি দিয়েছিলাম সমপরিমাণ।’

সর্বশেষ খবর