রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাঙালিপাড়া কোতারায়া

মাহাথিরের দেশে ৪

মাহমুদ আজহার, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে

বাঙালিপাড়া কোতারায়া

‘ঢাকার বিরানি খাইয়া যান, লইয়া যান।’ ‘নান আছে রুটি আছে কী লাগব ভাই।’ ‘আসেন আসেন রাজধানী হোটেলে আসেন, বাংলাদেশি খাবার খান। সুস্বাদু খাবার খান।’ দিনভর এমন সব স্লোগানে মুখরিত মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের জালান সিলাংয়ের কোতারায়া। এলাকাটি ‘বাংলা মার্কেট’ নামে পরিচিত। প্রতিদিনই বাংলাদেশিদের হাট বসে এই এলাকায়। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজনীতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় এই বাঙালিপাড়ায়। প্রতিদিনই বাংলাদেশিদের খুঁজে পাওয়া যায় এখানে।

 বিশেষ করে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই এলাকায় মিলনমেলা বসে। কুয়ালালামপুরের যে যেখানেই কাজ করেন না কেন, ওই দিন হাজার হাজার বাঙালি জড়ো হয় কোতারায়ায়। প্রাণ খুলে বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা গানের শব্দ পাওয়া যায় এই মার্কেটে। বাঙালিদের সব সমস্যার সমাধান যেন এই এলাকা। জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশি হয়রানির ভয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকরা খুব কম আসেন। এলেও দেখেশুনে পাসপোর্ট সঙ্গে নিয়ে আসেন। মাঝেমধ্যে বৈধ-অবৈধ বাংলাদেশি পেলেই ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। সব সময় বাংলা মার্কেট এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশ অবস্থান নেয়। কেউ রাস্তায় ময়লা আবর্জনা ফেললে কিংবা নোংরা করলে তাত্ক্ষণিকভাবে জেল-জরিমানা করে।

২২ বছর বয়সী তরুণ আরেফিন সবুজ। গ্রামের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী। বাংলা মার্কেটের সামনে মালয়েশিয়ান মোবাইল সিম বিক্রি করছেন। বাংলা ভাষায় ডাকছেন, ডিজি সিম নেন। ডিজি সিম। কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে। জানান, এক বছর ধরে তিনি মালয়েশিয়ায় থাকেন। তার পছন্দের জায়গা বাংলা মার্কেট। তাই মালয়েশিয়ান কোম্পানির সিম বিক্রির জন্য পছন্দের স্থান হিসেবে বাঙালিপাড়াকেই বেছে নিয়েছেন। ডা. শাহীন নামে এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা মার্কেটে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলা। তিনি জানান, আমি বাংলাদেশি। তাই বাঙালিপাড়ায় আমি আমাদের শ্রমিকদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। আলিমুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ী জানান, বাংলাদেশিদের নানা দুর্ভোগের কথা। তিনি বলেন, পুলিশের মন চাইলেই পাসপোর্ট-লাইসেন্স নিয়ে যায়। প্রতিবাদ করারও কিছু থাকে না। বিষয়টি মালয়েশিয়া বাংলাদেশ হাইকমিশনের গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। কোতারায়া বাংলা মার্কেটে রাজধানী রেস্টুরেন্টের মালিক শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার মশুরা গ্রামের কাজী সালাহ উদ্দিন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও সম্প্রতি তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।

সরেজমিন কোতারায়া ঘুরে দেখা গেছে, বাংলা মার্কেট এলাকায় ঢাকা বিরানি হাউস, দুটি বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্ট, তিনটি রাজধানী রেস্টুরেন্ট, দুটি সেরিস রেস্টুরেন্ট, দুটি বাসমতি রেস্টুরেন্ট, ফাতেমা রেস্টুরেন্ট, রাঁধুনি, কুটুমবাড়ি, ঘরোয়াসহ অন্তত ১৫টি বাঙালি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। বাঙালি মার্কেটে আট থেকে ১০টি কম্বলের দোকানও রয়েছে। এসব রেস্টুরেন্টে বাঙালির প্রিয় খাবার ভাত, ডাল, বিরানি, খিচুড়ি, বিভিন্ন প্রকার মাছ, মাংস, মুরগি, সবজি ও নানা প্রকার ভর্তা-ভাজি রয়েছে। মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশিরা বেশির ভাগ সময় এসব রেস্টুরেন্টেই খাবার খান। অবশ্য কুয়ালালামপুরের বাইরে থাকা অনেকেই সপ্তাহে অন্তত রবিবার হলেও বাংলা রেস্টুুরেন্টে খাবার খেয়ে যান। বাংলা মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কোতারায়া মালয়েশিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ততম বাণিজ্যিক শহরের মধ্যে একটি। বাংলা মার্কেটের পাশেই মালয়েশিয়ার জাতীয় পোস্ট অফিস, চায়না টাউন, স্বাধীনতা মাঠ, সেন্ট্রাল মার্কেট, কে এল টাওয়ার, মসজিদ ইন্ডিয়া, পাসার সিনি এল আর টি (মেট্রোরেল) স্টেশন, দূরপাল্লার ট্রেন (কেটিএম) স্টেশন এবং মালয়েশিয়ার বৃহত্তম একটি পুদু বাস টার্মিনাল। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এখানে পর্যটকদের আনাগোনা। ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলা মার্কেট প্রকৃত অর্থেই বাঙালিপাড়া। ভারতীয় বাঙালি এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের মানুষের সংখ্যাও অনেক।

এ ছাড়া কোতারায়ায় দেখা যায় পাকিস্তানি, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনদের। কোতারায়া যেন ঢাকার গুলিস্তান অথবা নিউমার্কেট।

সারা দিন বাঙালিদের ভিড় লেগেই থাকে। স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় দোকানপাট খুলতে থাকে। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে স্বাভাবিক কাজকর্ম। বিকাল হলে ব্যবসার পাশাপাশি জমে ওঠে আড্ডা। আড্ডায় অন্য কোনো এশীয়কে তেমন একটা দেখা যায় না। বাংলা মার্কেট ঘুরে আরও দেখা যায়, বাংলা মার্কেটে খাবার হোটেলের পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সি, মোবাইল, ইলেকট্রনিক শপ, মুদি স্টেশনারি, সেলুনসহ অন্তত ৫০টির মতো বাংলা দোকান রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক লি-এর একটি শাখা। বাংলা মার্কেটে বাংলাদেশি সব পণ্য পাওয়া যায়। কোতারায়ায় মালয়েশিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশি সব মোবাইল কোম্পানির সিমকার্ড ও ইন্টারনেট মডেম পাওয়া যায়। সিডির দোকানগুলোতে সারা দিন উচ্চ সুরে বাংলা গান বাজতেও দেখা যায়। কোনো কোনো দোকানের টিভিতে বাংলাদেশের খবরাখবর, বাংলা সিনেমা, নাটকসহ নানা অনুষ্ঠান প্রচার হতেও দেখা গেছে। সারিবদ্ধ হয়ে অনেকেই বাংলাদেশের খবরাখবর উপভোগ করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর