সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে অগ্রগতি হলেও শ্রমিকরা অবহেলিত

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার চার বছর

জিন্নাতুন নূর

কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে অগ্রগতি হলেও শ্রমিকরা অবহেলিত

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার চার বছর পূর্তি আজ। শ্রমিক সংগঠন, দেশি-বিদেশি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাপে এই চার বছরে পোশাক খাতের সংস্কারে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য গত চার বছরে ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের চাপে দেশের পোশাক কারখানাগুলোর ইতিবাচক সংস্কারও হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে আহত-নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য কোনো মানদণ্ড ঠিক করা যায়নি। এমনকি আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনেও তেমন কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। জানা যায়, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সদস্য-কারখানাগুলোর সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে যথাক্রমে ৭৭ ও ৭৫ শতাংশ। দুই জোটের কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও ভবনের কাঠামোগত প্রাথমিক ত্রুটি সংশোধনের কাজ শেষ হয়েছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মোট কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ২০৬টি। এরই মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ২০২টি কারখানার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। এ ছাড়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদফতর (ডিআইএফই) ১ হাজার ৫৪৯টি কারখানা পরিদর্শন শেষে ঝুঁকিভেদে ছয়টি ক্যাটাগরি তৈরি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রেড ক্যাটাগরিতে আছে ২৩টি কারখানা। এসব কারাখানার কোনোটিই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু প্রকৌশলীর অভাবে এই কারখানাগুলোর ফলোআপ পরিদর্শন হচ্ছে না। এ ছাড়া সংস্কার কাজে মালিকদের গাফিলতির জন্যও অনেক কারখানার সংস্কার কাজ হচ্ছে না। বর্তমানে সারা দেশের ৪ হাজার ৭৬৫টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৩ হাজার ৭৫৬টি পরিদর্শন করেছে অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও ডিআইএফই। কিন্তু এখনো ১ হাজার ৯টি কারখানা পরিদর্শনের বাইরে আছে। কারখানাগুলো পরিদর্শন শেষে এই তিন সংস্থা বিভিন্ন ধরনের সাড়ে ৭৪ হাজার সমস্যা চিহ্নিত করেছে। আর গত চার বছরে সমাধান হয়েছে ৩২ হাজার সমস্যা। ২০১৮ সালের মধ্যে অবশিষ্ট সমস্যা সমাধান করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সংস্কার কর্মসূচির বাইরে আছে আরও কয়েকশ পোশাক কারখানা। আর শেয়ারড বিল্ডিংয়ের পোশাক কারখানাগুলো এখনো বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে চার বছরেও পোশাক শ্রমিকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তাজনিত ও দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য ক্ষতিপূরণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে আইনগত দুর্বলতা আছে। আর দুর্ঘটনায় নিহত হলে বা চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য যে ক্ষতিপূরণ, এর জন্য যে আইন তাও এখন পর্যন্ত সংশোধন হয়নি। ফলে ক্ষতিপূরণের কোনো মানদণ্ড এখনো নির্ধারিত হয়নি। এখনো পুরনো নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। যেখানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার সেখানে একজন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করলে তার ক্ষতিপূরণ মাত্র ১২৫০ ডলার দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ অবহেলাজনিত মৃত্যু হলে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, এর কোনো মানদণ্ডই নেই। এমনকি দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থাও এখনো করা হয়নি। অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তির জন্য যে বিধান, সে আইনটিও নতুন করে পুনর্মূল্যায়িত হয়নি। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সঙ্গে কথা বলে এবং কিছু ক্রেতার চাপে কমপ্লায়েন্স ইস্যুটাকে চোখে পড়ার মতো স্থানে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন করার বিষয়গুলো এখনো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। বরং ক্রেতাদের চাপে কথা বলে উল্টো শ্রমিকদের বেশি খাটানো হচ্ছে। তিনি বলেন, চার বছরে রানা প্লাজায় আহতদের ৪২ শতাংশ এখনো বেকার। তাদের চিকিৎসাব্যবস্থাই বা কী হবে এসব বিষয় নিয়ে অবহেলা করা হচ্ছে। ঘটনাটি আমাদের যতটা আলোড়িত করেছে, ঠিক ততটা কিন্তু সতর্কতা তৈরি করতে পারেনি।’ পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পোশাক খাতের সংস্কারে আমরা যে কাজগুলো করছি তা দেখে আমাদের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশক খাতের ইমেজ পুনরুদ্ধারে প্রতিটি কারখানায় ইন্সপেকশন শুরু করা হয়েছে। যে ক্রেতারা আমাদের থেকে পোশাক কিনছেন তাদের বাংলাদেশে অফিস বা এজেন্ট আছে। তারা সব সময়ই কারখানাগুলো পরিদর্শন করছেন। ক্রেতারা দেখছেন আমরা গুরুত্ব সহকারে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আন্তরিক।’ এদিকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ থেকে কাপড় তৈরি করলেই সেই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জানাতে হবে। এতে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে কি না তা নজরদারি সম্ভব। যদিও এত দিন পর্যন্ত মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা ট্যাগ ছিল। কিন্তু এই পোশাক বাংলাদেশের কোন পোশাক কারখানা তৈরি করেছে তা জানা যেত না। যেমন এত দিন জানা যেত না সেই কারখানার শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ-সংক্রান্ত তথ্য। আর রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর এ তথ্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সে সময় দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা না বললে তাদের কর্মপরিবেশ-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যেত না। গত চার বছরে শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর চাপে বিশ্বব্যাপী বড় পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এ তথ্যগুলো দিতে শুরু করেছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো তথ্য প্রকাশ করছে না।

সর্বশেষ খবর