আশ্রয় কেন্দ্র বলতে স্কুল কলেজ মাদ্রাসার ঘর। সেগুলোর মেঝেতেও ২-৩ ফুট পানি। হাকালুকি হাওর তীরের মানুষের একটাই কথা— আমরা ত্রাণ চাই না, এই ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ চাই। আর পরিত্রাণের একটাই পথ হাকালুকি হাওরের সঙ্গে কুশিয়ারার সংযোগস্থলের সেই বুড়িকিয়ারি বাঁধ অপসারণ অথবা বর্তমান সংযোগস্থল জুড়ি নদী খনন ও প্রশস্তকরণ। তবেই হাওর পাড়ের মানুষের দুর্ভোগ কমবে। এই কথাগুলো হাওর পাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব মানুষের কথা। হাকালুকি হাওরের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ জুড়ি নদী খনন হয়নি বহুদিন, যার কারণে অল্প বৃষ্টিতেই বন্যা হয় হাওরে। গেল বোরো মৌসুমে অকাল বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও পানিবন্দী হয়েছে হাওর পাড়ের মানুষ। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে দেশের বৃহত্তম হাওর মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর পাড়ের প্রায় ৭০ গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ কয়েক দিন পানিবন্দী। ২১ জুন সরেজমিন দেখা যায়, কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের বাড়িঘরে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন এ ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ। পৌরসভা এলাকার বিহালা, সোনাপুর, বিছরাকান্দি এলাকায় মানুষের ঘরে হাঁটুপানি। এছাড়াও বরমচাল, ভাটেরা, কাদিপুর ও জয়চন্ডি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। জুড়ি উপজেলার জায়ফর নগর ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী। বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওর সংলগ্ন বর্নি, তালিমপুর, সুজানগর ও দাসেরবাজার ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার অন্তত ৩০টি গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে সুজানগর ইউনিয়নের দশঘড়ি, রাঙ্গিনগর, বাড্ডা, ঝগড়ি, পাটনা, ভোলারকান্দি, উত্তর বাঘমারা, তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা, ইসলামপুর, কুটাউরা, বাড্ডা, নুনুয়া, পাবিজুরি, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পশ্চিম গগড়া, পূর্বগগড়া, বড়ময়দান, গাগড়াকান্দি, তেলিমেলি, গোপালপুর, হাউদপুর, বর্ণি ইউনিয়নের পাকশাইল, সত্পুর, কাজিরবন্দ, নোওয়াগাঁও, উজিরপুর, দাসেরবাজার ইউনিয়নের চানপুর, অহিরকুঞ্জি, উত্তরবাগীরপাড়, দক্ষিণবাগীরপাড়, পানিশাইল, ধর্মদেহী, চুলারকুড়ি, কোদালী, ধলিরপাড়, নেরাকান্দি, মাইজমজুড়ি, মালিশ্রী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪-৫ দিন থেকে প্লাবিত এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে থাকলেও এখনো সরকারি ত্রাণ সাহায্য পাচ্ছে না কেউ। সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আজিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় ও দ্বিতীয়ারদেহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রায় ৩০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
বড়লেখার বড় ময়দান গ্রামের বাসিন্দা জিতেন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বন্যার পানিতে ঘর অর্ধেক ডুবি গেছে। বউ-বাচ্চারে শ্বশুর বাড়ি পাঠাই (পাঠিয়েছি) দিছি। নিজে কোনমতে অন্যের বাড়িত আশ্রয় নিছি। মেঘ (বৃষ্টি) আরও দিলে পানি বাড়ব তবে এখন কিছু কমের।’ কুলাউড়ার ভুকশিমইল গ্রামের ফয়জুল মিয়া পীর জানান, তার টিন শেডের ঘরের ভিতর কোমর পানি। তাই এ ঘরে বসবাস করতে না পারায় ঘরের সব মালামাল রেখেই উঠেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। একই গ্রামের সোহাগ মিয়া ও জাবেদ আলী জানান, তাদের বাড়িতে হাঁটু পানি। কারও বাড়িতে কোমর পানি। গ্রামের সব রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। তারা খুব দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন।
জুড়ি উপজেলার জায়ফর নগর গ্রামের আবদুল হেকিম জানান, ৪-৫ দিন থেকে পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। ঘরের চুলাও পানিতে ডুবে গেছে। তাই রান্নাবান্না করতে পারছেন না। তাই অনেকটা না খেয়ে আছেন। এ ছাড়াও তাদের বাড়িঘরে পানি ওঠায় তারা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই দুর্দিনে কেউই তাদের দেখতে যায়নি। প্রায় সব রাস্তাঘাটে হাঁটু পানি, কোথাও আরও বেশি। সামনে ঈদ। এলাকার মানুষ শহরের আসতে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় অস্থায়ীভাবে কুলাউড়ার পৌর এলাকার বিহালা গ্রামে এবং ভুকশিমইল গ্রামে নৌকার ঘাট স্থাপিত হয়েছে। মানুষজন নৌকাযোগে চলাফেরা করছেন। কিন্তু নৌকা স্বল্পতার কারণে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে বানভাসি মানুষের।