রবিবার, ২৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঈদেও ছুটি নেই যাদের

মির্জা মেহেদী তমাল

শুরু হয়ে গেছে ঈদ আনন্দ। জীবন বাজি রেখে মানুষ এখনো ফিরছে শিকড়ে। ছুটছে প্রিয়জনের কাছে। পথে পথে দুর্ভোগ পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছেই ভুলে যাচ্ছে তাদের পথের ক্লান্তি। পথের দিকে চেয়ে থাকা মা ছেলেকে এসে জড়িয়ে ধরছেন। আনন্দে কাঁদছেন। স্বামীর ফেরায় খুশিতে আত্মহারা স্ত্রী। বাবাকে ঘিরে সন্তানদের হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড। ঈদের নতুন জামা-কাপড় পেয়ে তাদের খুশির বাঁধ ভেঙে গেছে। ঈদের ছুটিতে প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা সবাই। এমন আনন্দ এখন ঘরে ঘরে হলেও কিছু মানুষের নেই কোনো ফুরসত। মেলে না ছুটি। উৎসব আনন্দে শামিল হতে পারেন না তারা। পেশাগত দায়িত্ব পালনেই তত্পর থাকতে হয়। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই যখন ঈদের খুশি ভাগাভাগিতে ব্যস্ত, পেশাগত কারণে দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে কিছু মানুষ থাকে উৎসব-আনন্দের ঊর্ধ্বে। কর্মস্থলে থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয় ঈদের দিনও।

ছুটি না পেয়ে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকা এসব মানুষ বলছেন, ‘পরিবার-পরিজনের জন্য সবারই মন কাঁদে। আমাদেরও কাঁদে। তবে এই ভেবে ভালো লাগে যে, বৃহত্তর মানব গোষ্ঠী ও দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে আনন্দ ত্যাগ করতে পেরেছি।’

জানা গেছে, দেশবাসীর ঈদ উদ্যাপন নির্বিঘ্ন করতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। স্বজনদের সময় না দিয়ে তারা জননিরাপত্তায় বিরামহীন দায়িত্ব পালন করছেন সারা দেশে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদেরও একটি বড় অংশ দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও অবস্থার তাত্ক্ষণিক তথ্য দেশবাসীকে জানাতে ঈদের দিনেও রাস্তায় ও অফিসে দায়িত্ব পালন করবেন। নিজেদের ঈদ আনন্দ বাদ দিয়ে টিভি পর্দায় তুলে ধরেন অন্যদের ঈদ আনন্দের খবর। নগরীর প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ডরাও বিভিন্ন বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, ব্যাংক ও বুথের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবেন ঈদের ছুটিতে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা থাকবেন সদা প্রস্তুত। মুমূর্ষু ও জরুরি রোগীদের সেবায় ঈদের দিনও হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করবেন চিকিৎসক, নার্স ও আয়ারা।

গেল বছরের জঙ্গি হামলা মাথায় রেখে সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। এসব কারণে পুলিশের বেশির ভাগেরই ছুটি বাতিল করা হয়েছে। স্বজনের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনে ঘরে ফেরেননি পুলিশের লক্ষাধিক সদস্য। ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত, রাস্তাঘাটে, ঈদগাহে, ঘরবাড়ি, ব্যাংক-বীমা আর বিনোদন কেন্দ্রের নিশ্চয়তা দিতেই ব্যস্ত থাকছে পুলিশ।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঈদ উদ্যাপনে যখন সবাই ব্যস্ত থাকবে ব্যতিক্রম তখন পুলিশ। দিন-রাত রাস্তায়, রেল, নৌপথ ও বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে রয়েছেন তারা। কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারাও রাস্তায় থাকবেন। ঈদগাহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পায়জামা-পাঞ্জাবির বদলে ইউনিফর্ম পরতে হবে তাদের। সরকারি ছুটিতে অফিস-আদালত যখন বন্ধ, তখন পুরোপুরিই খোলা রয়েছে থানা-ফাঁড়ি ও তদন্ত কেন্দ্র। সচল রয়েছে পুলিশের জনসম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো। শহরের ঘরবাড়িতে তালা মেরে মানুষজন চলে গেছে আনন্দ উৎসবে। আর আমরা উৎসবে যাওয়া মানুষদের ঘরবাড়ি নিরাপত্তা দিচ্ছি দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। রাজধানীর ফার্মগেটে ছাতা হাতে দায়িত্ব পালনকারী একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, পুলিশের চাকরি তো বোঝেনই। এমনিতেই নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। আর ঈদের সময় আগের মতো ছুটি পাওয়া যায় না। এর পরও ডিউটির চাপ থাকে বেশি। তবুও আক্ষেপ নেই তার। তিনি গত ঈদে ছুটি পেয়েছিলেন। তার অনেক সহকর্মী আছেন যারা দুই ঈদের কোনোটিতেই ছুটি পাননি।

ঈদে হাসপাতালে নতুন রোগীর তেমন চাপ থাকে না। তার পরও ডিউটি থেকে তো রেহাই নেই। বরং রোগী কমে যাওয়ায় দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার জানান, এবার তার বাড়িতে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ছুটি পাননি। তার ডিউটি আছে ঈদের দিন সকালে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী সাজিদ মিয়া জানান, গত ঈদে ছুটি পেলেও এবারের ঈদে ঢাকাতেই থাকতে হয়েছে তাকে। তার পেশাগত দায়িত্বের কারণে এখন তিনি এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একটি মোবাইল কোম্পানির আইটি বিভাগে কাজ করেন আমিন রশিদ। তিনি বলেন, ‘আইটিতে থাকা আমার দায়িত্বটা ইচ্ছা করলে বাসায় বসে অনলাইনে করে দিতে পারি। এই কথা বলেও ছুটি পেলাম না। অফিস করতেই হবে। কী আর করা। চাকরি করলে চাইলেই ছুটি পাওয়া যায় না ভাই।’

মিরপুর ১০ নম্বরে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড সফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, তার গ্রামের বাড়ি আলমডাঙ্গা। ঈদের সময় নিজের ৮ ঘণ্টা দায়িত্বের সঙ্গে ওভারটাইমও করতে হবে। এজন্য অবশ্য বাড়তি টাকা পাবেন তিনি। কিন্তু গ্রামে না যেতে পেরে তার মনটা খুব খারাপ লাগছে। তিনি বলেন, পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়িতে থাকে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঈদ করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু দায়িত্বের কারণে তা করতে পারছি না। ঈদের দিন কীভাবে কাটাবেন জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘নিজে রান্না করে খাব আর ডিউটি করব।’ বলেন, ‘ঈদের সময় ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছি না। পরিবারের সব সদস্য শরীয়তপুরে থাকেন। সবার জন্য ঈদের উপহার পাঠালেও ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারব না তাদের সঙ্গে। ঈদের দিন হাসপাতালে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর