রবিবার, ২৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্বামী-সন্তানহারা নিরানন্দ ঈদ

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

স্বামী-সন্তানহারা নিরানন্দ ঈদ

বাবা-মেয়ের আত্মহত্যায় জীবনে প্রথমবার স্বামী-সন্তানহারা হালিমা বেগমের ঈদ কাটবে অনেকটা নিরানন্দে। মেয়ের ওপর নির্যাতনের বিচার না পেয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরের কর্ণপুর গ্রামের মধ্যবয়সী হযরত আলী তার একমাত্র পালিত কন্যা আয়েশাকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আর এ ঘটনায় শ্রীপুর, গাজীপুর তথা পুরো দেশেই শুরু হয় তোলপাড়। হালিমাকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুুষ। ছুটে আসেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও। বিচার চেয়ে যে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, পুলিশের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েছেন হালিমা, সেই ব্যক্তিরাও তাকে সান্ত্বনা দিতে তার বাড়িতে ভিড় করেন। কিন্তু এসব সান্ত্বনায় হালিমার মন ভরেনি। এখন দুশ্চিন্তা, কীভাবে করবেন ঈদ। স্বামী নেই, নেই একমাত্র পালিত কন্যাও। কার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করবেন তিনি। কাকে কিনে দেবেন নতুন জামা। কাকে নিয়ে খাবেন সেমাই, পায়েস, পিঠা। আর এসব ভেবে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বামী-সন্তানহারা হালিমা বেগম। আজ তার বাড়িতে অনেকেই আসছেন। পাহারা দিতে রয়েছে পুলিশ, গ্রামপুলিশ। পাহারা কিন্তু ঠিকই পাচ্ছেন, তবে স্বামী-সন্তান হারিয়ে। জল-জঙ্গল-অরণ্যঘেরা গাজীপুরের শ্রীপুরের নিভৃত এই গ্রাম মানবতার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সাক্ষী। আর এই মানুষটি, যার নাম হালিমা বেগম, তিনি সেই নির্মমতার ক্ষতচিহ্ন এখন শুধু বয়ে বেড়াচ্ছেনই না, কেঁদে কেঁদে চোখও ফুলিয়েছেন। সন্তানহীন পৃথিবীতে, ধর্ষিতা মেয়ের বিচার চেয়ে চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি আজও তাকে প্রতি মুহূর্তে আহত করছে। তাই রমজানে তার চোখ ভেজা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। আর হতাশায় বিড়বিড় করে বলেন, ‘ঈদের দিন আমার মা (আয়েশা) নতুন জামা পরত। খেলা করত। এ-বাড়ি ও-বাড়ি ছুটে বেড়াত। এবার আমি কাকে কিনে দেব নতুন জামা। কে খেলা করবে। সব হারিয়ে গেল আমার।’ এদিকে নিয়ম করে পুলিশি পাহারা আর নিঃসঙ্গতায় তার দিন যেন আর কাটছে না। অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছেন হালিমা। আজও কি বিচার পাবেন, নাকি এভাবেই নীরবে-নিভৃতে কেটে যাবে হালিমার। না অন্য সব ঘটনার মতো একসময় মানুষ ভুলে যাবে শ্রীপুরের গভীর অরণ্যের হালিমাকে। এখন আর আগের মতো তেমন খোঁজখবরও নেয় না কেউ। কথা দেওয়া দু-একজন সাহায্য পাঠায় মাঝেমধ্যে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুই মাসে আশ্বাসের বাইরে কিছু পাননি হালিমা বেগম। তাই কবরের মাটি তার চোখের জল আর প্রার্থনায় আরও ভিজে উঠছে দিনকে দিন। আবার কখনো ভাঙা ঘরের জানালায় বসে আঙিনার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকছেন হালিমা। তখনো তার চোখ ভেজা, ভীষণ ভেজা। ঘর-সংসারও শিকেয় উঠেছে তার। স্বামী-সন্তানের স্মৃতিচিহ্নগুলোও দিন দিন মলিন হচ্ছে। কারণ নিঃসঙ্গ আর ক্ষুব্ধ তিনি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন স্বামী-সন্তানের কবরের দিকে। তবে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মামলার আসামিরা গ্রেফতার হয়ে রয়েছেন জেলখানায়। গতকাল গাজীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল শ্রীপুরের কর্ণপুর স্বামী-সন্তানহারা হালিমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে একজন পুলিশ সদস্য আনসার ও গ্রামপুলিশ নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। আর হালিমা বেগম বাড়ির ভিতর একাকী। ঈদ অনুভূতি জানতে চাইলে হালিমা বেগম বলেন, ‘কিসের ঈদ! আমার মা (আয়েশা) নেই। কীভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করব। আমার মা আয়েশাকে এনে দাও। আমি আমার মাকে চাই। একসঙ্গে ঈদ করব।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন হালিমা বেগম। প্রসঙ্গত, ২৯ এপ্রিল শ্রীপুর রেলস্টেশনের পশু হাসপাতাল-সংলগ্ন এলাকায় চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে মেয়ে আয়েশা আক্তার ও বাবা হযরত আলী আত্মহত্যা করেন। মেয়েকে শ্লীলতাহানি, গরু চুরি যাওয়া ও প্রতিবেশীদের হামলার হুমকির বিচার না পাওয়ায় বাবা-মেয়ে আত্মহত্যা করেন।

সর্বশেষ খবর