সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাঠ্যবইয়ে পাতা ছেঁড়া কাগজও নিম্নমানের

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

পাঠ্যবইয়ে পাতা ছেঁড়া কাগজও নিম্নমানের

ঝরে পড়া ও পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের মতোই অবহেলিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) পাঠ্যবই। ছেঁড়া পাতা, নিম্নমানের কাগজ যেন এখানকার পাঠ্যবইয়ের সঙ্গী। পাঠ্যবইয়ের ওপরের কভার পাতায় চাকচিক্য থাকলেও ভিতরের চিত্র ভিন্ন। কভার পাতা উল্টালেই অস্পষ্ট ছাপা, নিম্নমানের কাগজ ও ছেঁড়া পাতা চোখে পড়বে। পাঠ্যবইয়ের ছাপার অক্ষরগুলোর যেন কালি মুছে যাচ্ছে। আধুনিক যুগে এসেও সিটিপি, পজেটিভ ছাড়া নিম্নমানের ট্রেসিং পেপারে প্লেট বানিয়ে বাঙলা কালি দিয়ে ছাপানো হয় এসব বই। অথচ দেশে অন্য সব বিষয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাপার জগৎও ডিজিটাল হয়েছে বহু আগে। কিন্তু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই ছাপতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না। একটি পক্ষের সুবিধা গ্রহণের কারণেই এমনটি হচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শুধু যে পাতা ছেঁড়া তা নয়, মাঝেমধ্যে বইয়ের পাতাও থাকছে নিখোঁজ। হয়রানির শেষ নেই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। অভিযোগ রয়েছে, বই হাতে পেতে শিক্ষার্থীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। শুধু তা-ই নয়, পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার পরও হাতে মেলে না পাঠ্যবই। আর এভাবেই চলছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নামের এই প্রতিষ্ঠান। অথচ একের পর এক হয়রানির শিকার হয়ে ঝরে পাড়া শিক্ষার্থীরা এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঠ্যবইয়ের বিকল্প ই-বুকের কথা বললেও ই-বুকেও মিলছে না পাঠ্যবই। এখনো হয়নি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের সহায়ক টিভি চ্যানেল।

জানা গেছে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫টি আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রামে এ বছর ৫ লাখ ২১ হাজার ৬৭৬ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র ও ১ হাজার ৬০০ স্টাডি সেন্টারে পাঠদান করছেন ২৪ হাজার শিক্ষক।

পাঠ্যবই ছাপার সংখ্যার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগের জয়েন্ট ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলীর কাছে। কিন্তু তিনি প্রথমে সময় দেননি। ঘণ্টাখানেক পর জানান, বই-সংক্রান্ত কোনো তথ্যই জানাতে পারবেন না তিনি। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতনের অনুমতি ছাড়া কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। তবে চাপাচাপির পর বলেন, ‘আমাদের জানামতে পাঠ্যবইয়ে কোনো ধরনের ছেঁড়া পাতা নেই।’ তবে তিনি বই থেকে পাতা নিখোঁজের বিষয়টি শুনে চমকে যান। পাঠ্যবইয়ের কাগজের মান নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশি ৬০ গ্রাম কাগজে পাঠ্যবই ছেপে থাকি।’ অথচ এ সময় ৪৭ গ্রামের কাগজে ছাপা বই দেখালেও তিনি জোর করে বলতে থাকেন এটি ৬০ গ্রামেরই কাগজ। অভিযোগ রয়েছে, পাঠ্যবই ছাপা-সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে আর্থিক সুবিধায় তাদের পছন্দের লোক দিয়ে বই ছাপতে দেন। আর এই সিন্ডিকেটের কারণেই নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপা হয়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামের একটি বই ঢাকার বাবুবাজারের পাইকারি খাজা পেপার হাউজে যাচাই করে দেখা যায়, কাগজগুলো ৫০ গ্রামের চেয়ে কম এবং বিদেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাউবির এক কর্মকর্তা বলেন, পাঠ্যবই ছাপার বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগই লোপাট হয়ে যায়। আর এসব কারণে সময়মতো বই ছাপানো হয় না। এক বছরের বই না ছেপে বরাদ্দকৃত পুরো অর্থই লোপাট করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই বই না ছাপানোর জন্যই গত বছর শিক্ষার্থীরা এক বছরের সেশনজটে পড়েছেন। এদিকে পাঠ্যবই সময়মতো দিতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশন গ্যাপ দিয়ে থাকে। এসব যেন তদারক করার কেউ নেই।

রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহরে বাউবির যেসব আঞ্চলিক বা উপকেন্দ্র রয়েছে, এগুলোর অধিকাংশে ক্লাস শুরু হওয়ার ছয়-সাত মাসের মাথায়ও শিক্ষার্থীরা হাতে বই পাননি।

জানতে চাইলে মহাখালী টিঅ্যান্ডটি কলেজের ছাত্র ইমরান বলেন, ‘এইচএসসিতে ভর্তি হয়ে ছয় মাস পর বই পাই। কিন্তু বইয়ের পাতা ছেঁড়া। কলেজকে জানালে তেমন কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।’ কক্সবাজার ডিগ্রি কলেজ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে একাদশ শ্রেণিতে প্রথম সেমিস্টারে ভর্তি হওয়া মিরাজ বলেন, ‘প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে যেমন ভোগান্তি হয়েছে, তেমনি ভোগান্তি হয়েছে পাঠ্যবই নিয়ে। একে তো বই পেতে দেরি, তার ওপর পাতা ছেঁড়া। বাংলা বইয়ের ২৩ নম্বর পাতা থেকে ২৭ নম্বর পাতা নেই।’ এইচএসসি পাস করা একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতির কারণে অনার্সে ভর্তি হতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে তাদের। তারা জানান, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পাঠ্যবইয়ের এমন অবস্থা। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর ২৯ ডিসেম্বর এসএসসি প্রোগ্রামের ভর্তি শেষ হয়। অথচ এখনো ছাত্ররা হাতে পাঠ্যবই পাননি। শুধু তা-ই নয়, পাঠ্যবইয়ের অভাবে বেশির ভাগ স্কুলে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়নি। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পাঠ্যবই পেতে সময় লাগলেও ছাপাতে কোনো অনিয়ম হয়নি।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, ‘নতুন করে সৃজনশীল করায় পাঠ্যবই ছাপতে দেরি হয়েছে। তবে আমরা ই-বুকের সুবিধা রেখেছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর