বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
একাল-সেকাল

সেই বোস কেবিন

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

সেই বোস কেবিন

কালের সাক্ষী নারায়ণগঞ্জ শহরের বোস কেবিন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বোস কেবিনের অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো অনেক নেতা এই বোস কেবিনের চা পানে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। প্রায় ৯৫ বছর ধরে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে বোস কেবিনের চায়ের যশ ও সুনাম। কিন্তু কালের স্রোত ও আধুনিক যুগে বোস কেবিনের সেই যশ, সুনাম, জৌলুস ও রক্ষণশীলতা যেন হারিয়ে যেতে শুরু করেছে।  রবিবার বেলা ১১টায় সরেজমিন শহরের ২ নং রেলগেট এলাকায় বোস কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৯৫ বছর আগে একটি টং ঘর দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া বোস কেবিন পাল্টে গেছে নানা আধুনিকতার ছোঁয়ায়। দোকানের দেয়ালে টাইলস দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। ব্যবহার করা হচ্ছে উন্নতমানের টেবিল, চেয়ার ও ক্রোকারিজ। এ সময় দেখা ও  কথা হয় বোস কেবিনে প্রায় ৬০ বছর ধরে আড্ডা দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত সোনালী ব্যাংকের এজিএম এম তরিকত হোসেনের (৭৬) সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বোস কেবিনের সেই পরিবেশ আর নেই। এক সময় এই কেবিনে শিক্ষিত ও ভদ্রলোকের সমাগম ছিল। বিশিষ্ট ও সংস্কৃতিনিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের এখানে প্রবেশে ছিল অনেকটা অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এখন নির্দিষ্ট শ্রেণির সীমারেখা নেই।  একটা সময় কেউ কারও পাশে বসলেও কার পাশে বসছে তা চিন্তা করত। তিনি আরও বলেন, এ স্থানটা ছিল নীরব গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ আড্ডাস্থল। কিন্তু এখন বিভিন্ন শ্রেণির আগত মানুষের উচ্চৈঃস্বরে খাবারের অর্ডার দেওয়ার শব্দ দূষণ ও বাহ্যিক আচার-আচারণ বর্তমানে বোস কেবিনের ইতিহাসের সঙ্গে অত্যন্ত বেমানান। বোস কেবিনে প্রথম আগমনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৫৮ সালে কলেজে ভর্তি হই। সেই সময় দুই আনা দিয়ে চা খাওয়া শুরু করেছি। সেই যে প্রেমে পড়লাম বোস কেবিনের। এখন এক কাপ চা ১২ টাকা।’ কথা হয় বোস কেবিনে ৪৫ বছর ধরে চাকরিরত কর্মচারী গোপিদার সঙ্গে। কাস্টমারদের চা বিতরণ ও টেবিল পরিষ্কারের ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে বোস কেবিনে ওয়েটার হিসেবে কাজ শুরু করেছি। ৬ টাকা রোজের বেতন এখন ৩০০ টাকা হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত অনেক সহকর্মীকে হারিয়েছি। বয়স হয়ে গেছে ৭০। অনেক কিছুই মনে করতে বা রাখতে পারি না।’ এদিকে ২০২১ সালে বোস কেবিনের ১০০ বছর পূর্তি হবে।  ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন বোস কেবিনকে জাতীয়ভাবে উপস্থাপনের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছে।

শুরুর কথা : নারায়ণগঞ্জ ১ ও ২ নম্বর রেল গেটের মাঝামাঝি, ফলপট্টির কাছাকাছি রেললাইনের পাশেই ১৯২১ সালে একটি টং ঘরে এই বোস কেবিনের যাত্রা শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নৃপেন্দ্র চন্দ্র বসু। তিনি ভুলুবাবু নামেই বেশি পরিচিত।

শুরুর কথা বলতে গিয়ে ভুলুবাবুর নাতি তারক চন্দ্র বসু বলেন, কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা নৃপেন্দ্র চন্দ্র বসু ওরফে ভুলু বোস বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। যিনি ১৯২০ সালে এন্ট্রাস পাস করেন। সে সময় তিনি দারোগার চাকরি পেয়েও তা করেননি। তার চিন্তায় তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর বাঙালিদের মধ্যে এক গোপন সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ওই স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ২১ বছরের যুবক ভুলু বোস। কলকাতা থেকে সিদ্ধান্ত হওয়া ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিঠি আদান-প্রদানের বাহক ছিলেন তিনি। কিন্তু এ চিঠি আদান-প্রদান নিয়ে একটি সমস্যা দেখা দেয়। কীভাবে কলকাতার সেই চিঠি তিনি নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাবেন তা নির্ধারিত ছিল না। এ সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯২১ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের ১ নং রেলস্টেশন ও স্টিমার ঘাটের কাছে বোস কেবিন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কেবিনের ঠিকানায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিঠি আসত। ১৯৩৭ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নারায়ণগঞ্জ এলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে দাদা ভুলুবাবু, কড়া ও হালকা লিকারের দুই কেতলি চা বানিয়ে ছোটেন নেতাজীর কাছে। সেই চা খেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন নেতাজী। আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘তুমি একদিন ভালো করবে, বড় হবে।’ জানা গেছে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথমদিকে যাদের পা পড়েছিল এই বোস কেবিনে তাদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী উল্লেখযোগ্য।

এখানকার মেন্যু : সকালের নাস্তায় পাওয়া যায় পরোটা। দাম ৫ টাকা। ডাল ও হালুয়া ৮ টাকা। ডিমের ৬ রকমের পদ। এ ছাড়া খাসি ও মুরগির মাংস। দুপুর ১২টা থেকে পাওয়া যায় আলুর চপ ১৫ টাকা। পোলাও ৪০ টাকা। মোরগ পোলাও ৮০ টাকা। কারি ৮০ টাকা। চিকেন কাটলেট ৭০ টাকা। বোস কেবিনের চায়ের খুব নাম। যে চা নেতাজী খেয়েও প্রশংসা করেছিলেন, সেই কড়া লিকারের চা বড় বড় কাপে পান করতে পারেন বর্তমানে ১২ টাকায়। সারা দিনই এখানে চা পাওয়া যায়। বোস কেবিন খোলা থাকে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর