বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

শক্তিশালী প্রার্থীদের লড়াই সবার চোখ নারায়ণগঞ্জে

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

শক্তিশালী প্রার্থীদের লড়াই সবার চোখ নারায়ণগঞ্জে

ঢাকার পড়শি প্রাচ্যের ডান্ডি শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জেও বইছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এমনকি ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয় এই নারায়ণগঞ্জে। তাই নারায়ণগঞ্জকে বলা হয় রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র। এ আসনের প্রায় সব প্রার্থীই শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী। তাই নির্বাচনে সব সময়ই এখানে হয় কোটি টাকার খেলা। জেলায় বর্তমানে পাঁচটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনজন ও জাতীয় পার্টির দুজন এমপি রয়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল। এ ছাড়া এ শিল্পনগরীতে জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে আগামী নির্বাচন ঘিরে পাঁচটি সংসদীয় (২০৪, ২০৫, ২০৬, ২০৭ ও ২০৮) আসনের বিভিন্ন এলাকায় এখনই ঝুলছে রংবেরঙের পোস্টার-ব্যানার। চলছে নানা ধরনের প্রচারণা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব দলের সম্ভাব্য প্রার্থীই ইতিমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন। কেন্দ্রীয় সবুজ সংকেত পেতেও সিনিয়র নেতাদের দ্বারস্থ হচ্ছেন তারা।

নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বর্তমান এমপি গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম দস্তগীর (বীরপ্রতীক)। এমপি হলেও গাজী গোলাম দস্তগীর রূপগঞ্জে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার আশপাশের লোকজনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে রূপগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন এখন গাজীর হাতছাড়া। স্থানীয় আওয়ামী লীগও এবার বহিরাগত কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হোক— এমনটা চায় না। বহিরাগত প্রার্থী ঠেকাতে একাট্টা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক এমপি কে এম সফিউল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই, রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শাহজাহান ভূঁইয়া এবং কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক। বিএনপি থেকে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় আলোচনায় শক্ত অবস্থানে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি প্রভাবশালী নেতা কাজী মনিরুজ্জামান। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ‘কাজী ভাই’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও যুবদলের কেন্দ্রীয় সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান দীপু ভূঁইয়াও এ আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী।

নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান এমপি নজরুল ইসলাম বাবু। এ আসনে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। তবে এমপি বাবুর পরিশ্রমে ডাকাতের উপজেলা হিসেবে পরিচিত আড়াইহাজারের অলিগলিতে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। দলের কাছে বাবুর একক ইমেজ তৈরি হয়েছে। এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক প্রবীণ নেতা বদরুজ্জামান খসরু। তবে যুবদলের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদও মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সদস্য আতাউর রহমান খান আঙ্গুরও মনোনয়নপ্রত্যাশী। নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে রয়েছে আওয়ামী লীগ জোটের হিসাব-নিকাশ। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির জোটের কারণে এখানে কপাল পোড়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর। জোট বাটোয়ারায় এ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সভাপতি লিয়াকত হোসেন খোকা। নবাগত এমপি হয়ে এলাকায় তিনি ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। এ ছাড়া মহিলা পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অনন্যা হোসেন মৌসুমীও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এরই মধ্যে প্রচারণা শুরু করেছেন। তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবদুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত এবার ছাড় দিতে নারাজ। তিনি আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মাসুদ দুলালও এ আসনে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সাবেক এই ছাত্রনেতা। এ ছাড়া সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালাম ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেনও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী।

বিএনপি থেকে এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রেজাউল করিম। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। এ সুযোগে দলের ভিতরে-বাইরে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আজহারুল ইসলাম মান্নান। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে মান্নান বর্তমানে সোনারগাঁ উপজেলা চেয়ারম্যান। এ আসনে বিএনপির আরও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল ও সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু জাফর।

নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এ কে এম শামীম ওসমান। তাকে কেন্দ্র করেই জেলায় আওয়ামী লীগে রয়েছে ‘শক্ত বলয়’। বিরোধী দল বিএনপি থেকে শুরু করে বামপন্থি ও জামায়াত অনেকেই চেষ্টা করেছে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে শক্ত ভিত স্থাপন করতে। কিন্তু শামীম ওসমানের দৃঢ় নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটির ভিত নাড়াতে পারেনি কোনো দলই। সাংগঠনিক ক্ষমতায় পরিপূর্ণ শামীম ওসমানরে আধা ঘণ্টার ডাকেই লাখো সাধারণ মানুষ জড় হয়ে যায়। দলের জন্য এমন কোনো আত্মত্যাগ নেই যা শামীম ওসমানের করতে হয়নি। দেশের প্রথম বোমা হামলার শিকার হয়ে বার বার প্রাণনাশের মতো হামলা হওয়ার পর শামীম ওসমান উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ত্যাগী নেতা হিসেবে শামীম ওসমানের কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে নিজ এলাকা থেকে শুরু করে জেলার উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ রেখেছেন এই এমপি। ধাপে ধাপে নিজ এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমানের কোনো বিকল্প প্রার্থীর নাম শোনা যায়নি। বিএনপি থেকে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির ১ নম্বর সহসভাপতি শিল্পপতি শাহ আলম। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। সম্ভাব্য দুই প্রার্থীই মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। ফতুল্লা থানা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুও তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনে বতর্মান এমপি জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ও বিকেএমইএ’র সভাপতি সেলিম ওসমান। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সেলিম ওসমান। উপনির্বাচনে প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানকে সম্মান করে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। তবে এ আসনে আগামীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান দীপু ও আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরজু রহমান ভূঁইয়া। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্য থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সাবেক এমপি এস এম আকরাম।

এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় এগিয়ে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি সভাপতি সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন মহানগর বিএনপির সহসভাপতি ও গত নাসিক নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। তবে প্রার্থী তালিকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের নামও শোনা যাচ্ছে।

* রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর হানিফ, সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি এম এম শাহীন ও সোনারগাঁ প্রতিনিধি আল আমিন।

সর্বশেষ খবর