বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাবিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের জ্বলন্ত প্রতীক ভাস্কর্য

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

রাবিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের জ্বলন্ত প্রতীক ভাস্কর্য

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তি সংগ্রাম। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের অবদানের স্মৃতি অম্লান রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য। শাবাশ বাংলাদেশ : স্বাধীনতার জ্বলন্ত প্রতীক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত ভাস্কর্য, শাবাশ বাংলাদেশ, শাবাশ। এর স্থপতি শিল্পী নিতুন কুণ্ডু। এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকী ভাস্কর্য। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতীকী ভাস্কর্যগুলো রয়েছে তার মধ্যে প্রকাশ-ভঙ্গির সরলতা, গতিময়তা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তেজস্বী প্রকাশ এবং নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে এই ভাস্কর্যটি অনবদ্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ অনেক শিক্ষক-ছাত্রের স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ হয় সিনেট ভবনের দক্ষিণে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজ শেষে হলে এর ফলক উন্মোচন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ভাস্কর্যটির থিম নেওয়া হয়েছে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার— ‘শাবাশ বাংলাদেশ, পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়, কবিতার এই পঙক্তি থেকে। ভাস্কর্যটিতে দুজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতির পেছনে রয়েছে ৩৬ ফুট উঁচু একটি দেয়াল। দেয়ালের ওপরের অংশে রয়েছে একটি বৃত্ত। এই বৃত্ত স্বাধীনতার সূর্যের প্রতীক। ভাস্কর্যটির নিচের দিকে ডান ও বাম উভয় পাশে ৬-৫ ফুট আয়তাকার দুটি দেয়ালে রয়েছে দুজন যুবক-যুবতী। যুবকের কাঁধে রাইফেল, মুখে কালো দাড়ি, কোমরে গামছা বাঁধা। এই যুবক মুক্তিযোদ্ধা বাউলের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে বাউল, লোকজশিল্পীসহ বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন তা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। বাউল তরুণের পাশে রয়েছে একতারা হাতে বাউল তরুণী। ডান দিকের দেয়ালে রয়েছে মায়ের কোলে শিশু, দুজন তরুণী। একজনের হাতে পতাকা। পতাকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে গেঞ্জি পরা এক কিশোর। দেয়ালের প্রতিকৃতিতে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধে যে নারীসহ সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। শিল্পীর এই অনবদ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো  যে যৌবনের ধর্ম, সে কথাই যেন প্রতিভাত হয়েছে।

স্ফুলিঙ্গ (শহীদ শামসুজ্জোহা স্মৃতি ভাস্কর্য) : ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা থাকায় তৎকালীন প্রক্টর শামসুজ্জোহা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন সেনাসদস্যদের। কিন্তু সেনাসদস্যরা তার কথা উপেক্ষা করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করে। তার মৃত্যুর পরপরই তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করেন শহীদ শামসুজ্জোহা হল এবং হলের মূল ফটকের পাশে একটি স্মৃতি স্মারক ভাস্কর্য স্ফুলিঙ্গ নির্মাণ করা হয় ২০১২ সালে। এটি ১৫ ফুট উচ্চতা, ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৪ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট।

বিদ্যার্ঘ ভাস্কর্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার যে প্রয়াস চালিয়েছিল, তাতে আক্রান্ত হয়েছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হানাদার বাহিনীর একটি বড় অংশ ঘাঁটি গেড়ে বসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময় যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে দেশ স্বাধীনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আমাদের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে অধ্যাপক হবিবুর রহমান অন্যতম। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা তার বাসায় অভিযান চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তার সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে তার নামে নির্মাণ করা হয় শহীদ হবিবুর রহমান হল। এরপর তিনিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতা যুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গেছেন তাদের স্মৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হবিবুর রহমান হলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করে। এ ভাস্কর্যটির নাম ‘বিদ্যার্ঘ’। ২০১১ সালের ২৬ মার্চ ভাস্কর্যটি উন্মোচন করা হয়। ভাস্কর্যটির স্থপতি হলেন শাওন সগীর সাগর।

সর্বশেষ খবর