বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
কৃষি সংবাদ

হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ

মোস্তফা কাজল

হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ

এক সময় সারা দেশের খাল ও বিলে মিঠা পানির আড়াইশ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে এ সংখ্যা ২১০-এ দাঁড়িয়েছে। ৪০ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তির তালিকায়। এ অবস্থায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে দেশের ৬৪ জেলায় মৎস্য কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। গতকাল এ চিঠি পাঠানো হয়। চলতি বছরের মৎস্য মেলার অভিজ্ঞতা থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞমহলের মতে দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ১৪টি। এগুলো হচ্ছে— জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের অবাধ চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো। জানতে চাইলে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানত ১৪ কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে আমরা পুরো দেশে মাছের উৎপাদন বাড়াতে সব জেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছি। তিনি জানান, যেসব মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মহাশোল, বাঁশপাতা, খইলশ্যা ও ভূতুম। এ ছাড়া পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড় মাছের চাষ হচ্ছে। পাঙ্গাশের চাষ হচ্ছে আগে থেকেই। কৈ মাছেরও চাষ হচ্ছে। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, অবাধে লবণ পানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ, ফসলের খেতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎস্য খনি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণাঞ্চলে দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। মিঠাপানির সুস্বাদু মাছ এখন আর তেমন মিলছে না। দেশি মাছের বদলে এখন বাজারে জায়গা দখল করেছে চাষ করা পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চেং, টাকি, চিতল, গতা, পোয়া, বালিয়া, উপর চকুয়া, কাকিলাসহ প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। গ্রামে একসময় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘেরের পানি কমতে থাকলে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়ত। অথচ এখন অনেক গ্রামেই দেশি প্রজাতির মাছ নেই। শীতকালের বাইরে বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন। তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। মৎস্য অধিদফতর সূত্র বলছে, দুই দশক আগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পাওয়া যেত। এখন এগুলো বিলুপ্তির পথে। রাজধানীর মিরপুর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী ও সাভার উপজেলার বাসিন্দা আবুল মিয়া বলেন, ১৫-১৬ বছর আগেও তেমন একটা মাছ কিনতাম না। শুধু ইলিশ মাছ কিনতাম। মাছের প্রয়োজন হলে বাড়ির সামনের খালে বা নদীতে চলে যেতাম। খালে, পুকুরে তখন এত মাছ ছিল কেউ খালি হাতে নেমেও হাতিয়ে মাছ ধরতে পারতেন। মৎস্য খামারি সালাউদ্দিন মুফতি বলেন, ২০ বছর আগেও জেলা-উপজেলায় অনেকে পুকুর থেকে মাছ ধরতেন। জাল, ডালা, খুচন নিয়ে মাছ ধরতে নেমে যেত ছোট-বড় সবাই। কেউ কেউ হাতিয়ে মাছ ধরত। শোল, গজার, টাকি, চিংড়ি, শিং, কই, টেংরা, পাবদা, ফলিসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ধরা পড়ত। তবে এখন পুকুরে চেলা, পুঁটি, বেলে ছাড়া  কোনো মাছ নেই। এদিকে চলতি বছরের মার্চ মাসে নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হাওর এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠেছিল। সংশ্লিষ্ট জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ধান পচে হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়ে অক্সিজেন কমে যাওয়ার কারণেই মাছ মরে গেছে। তবে হাওর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ভিদ পচে অ্যামোনিয়া তৈরি হয় না। অন্য কোনো কারণ আছে। সেগুলোকে খুঁজে বের করতে খুব দ্রুত বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হবে বলা হলেও তা রহস্যজনক কারণে এখনো সম্ভব হয়নি। গবেষণার পরিকল্পনাও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নেই।

সর্বশেষ খবর