মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিমানের গুরুত্বপূর্ণ তিন পরিচালক পদ পূরণ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাত মাস ধরে শূন্য পড়ে আছে বাংলাদেশ বিমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক (প্রকৌশল) পদটি। পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালকও নেই গত দু’বছর ধরে। একই অবস্থা কাস্টমার সার্ভিসে। এ তিনটা বিভাগের পরিচালক পদে লোক দেখানো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাক্ষাত্কার নেওয়া হলেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। যারা এসব পদে যোগ্য-অভিজ্ঞ, তাদেরকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে বাইরে থেকে অযোগ্য আনাড়ি লোক নিয়োগের পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিমানের একটি মহল। এই অনিয়মের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে বিমান কর্মীরা। বিমানের ভিতর ও বাইরের প্রভাবশালী মহলের তত্পরতায় এসব পদে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে বিমানের গতিশীল সেবা দূরে থাক অচল হয়ে পড়েছে এসব বিভাগের কর্মকাণ্ড। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ কর্তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের কারণে এসব পদে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিচালকের তিনটি শূন্য পদই শিগগির পূরণ হয়ে যাবে। বিমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ প্রকৌশল। সার্বক্ষণিক উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে এখানকার পেশাদার ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা। গত মার্চ মাসে পরিচালক উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামানের চাকরির মেয়াদ আর না বাড়ানোয় পদটি শূন্য হয়ে যায়। অদ্যাবধি সেটা পূরণ করা হচ্ছে না। যদিও উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান চলে যাবার দীর্ঘদিন পর এ পদটি পূরণের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজও সে পদে নিয়োগ দিতে পারেনি বিমান। এ বিষয়ে একজন সাবেক পরিচালক জানান, বিমানের বর্তমান বোর্ড ও ম্যানেজমেন্ট কতটা অথর্ব ও অদক্ষ এটাই তার বড় প্রমাণ। এমন একটা পদ পূরণ করতে পারেনি গত ৭ মাসে। অথচ এ ধরনের পদ সাধারণত শূন্য হওয়ার তিন মাস আগে থেকেই যোগ্য  লোকের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। এটা করপোরেট কালচার হলেও বিমানের কেউ তা অনুধাবন করতে পারেনি। একই অবস্থা পরিচালক কাস্টমার সার্ভিসের। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একজন অভিজ্ঞ জিএম আতিক সোবহানকে দিয়ে পরিচালকের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দেওয়া হয় মার্কেটিং পরিচালক আলী আহসান বাবুকে। এতে তিনি মার্কেটিং ও কাস্টমার সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খান। যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে পদোন্নতি না দিয়ে উল্টো একজনকে দুই দায়িত্ব দিয়ে কাজ করানোর ফলে যাত্রী সেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতে বিমান ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ অসন্তোষ বাড়ছে। এক পর্যায়ে বিমান কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের পরিচালক পদ পূরণের জন্যও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। তখন এ পদে দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী আতিক সোবহানসহ ৮ জন আবেদন করেন। কিন্তু লিখিত ও মৌখিক  পরীক্ষায় আতিক সোবহান ভালো করার পর রহস্যজনক কারণে তার ফলাফল প্রকাশ করেনি বিমান। এ সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমান এ পদে সাইফুল ইসলাম নামের লন্ডন প্রবাসী একজনকে নিয়োগ দিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে একজন পর্ষদ সদস্য জোর চাপ সৃষ্টি করেছেন। এমনকি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির তদবির থাকার কথা বলে বিমান ওই লন্ডন প্রবাসীকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে এ বিষয়টি তদন্ত করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত হয়— ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ভাঙ্গিয়ে মিথ্যা তদবির করে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে লন্ডন প্রবাসী ওই প্রার্থী। বিমানের একজন পরিচালক জানান, পরিচালক কাস্টমার সার্ভিস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি হাজার হাজার যাত্রীর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, ফ্লাইট সিডিউল ঠিক রাখার মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয় এই পরিচালককে। এমন পদে আতিক সোবহানের মতো দুই যুগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারাই হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে কি করে এমন একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে যিনি জীবনে কোনোদিন এক ঘণ্টার জন্যও কোনো এয়ারলাইন্সের কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করেননি? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পর্ষদ সদস্য জানান, এ সংক্রান্ত নিয়োগের জন্য একটি সাব কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি ওই লন্ডন প্রবাসীর নাম অনুমোদন করেছে। এটি পরবর্তী পর্ষদ সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও বিমানের বেশিরভাগ পর্ষদ সদস্যই এ নিয়োগে সম্মত নন। বিমানের সাধারণ কর্মচারীদের ভাষ্যমতে, এ পদে বাইরের কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হলে গ্রাউন্ড সার্ভিসের কাজে আরও বিপর্যয় নেমে আসবে। তাকে বিমান থেকে সহযোগিতা করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এতে বিমান যে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে সেটা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। মাস দুয়েক আগে পরিচালক প্রশাসন পদে মমিনুল ইসলাম থাকার পরও জয়নাল বারি নামের একজনকে মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে মমিনুল ইসলামের পক্ষে আদালতে রিট করা হলে জয়নাল বারিকে ফেরত যেতে হয়। একই পরিণতি ঘটতে পারে পরিচালক কাস্টমার সার্ভিসের ক্ষেত্রেও। পরিচালক পরিকল্পনা ও স্টোর বিভাগেরও দুুটো পদ শূন্য রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন। এখানে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও বিমান রহস্যজনক কারণে এটা পূরণ করছে না। এ পদে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করার পরও নিয়োগ দেওয়া হয়নি সিনিয়র জিএম খান মোশাররফকে। উল্টো এ পদে যাতে যোগ দিতে না পারে সেজন্য তাকে কোণঠাসা করে, তাকে বিমান প্রেসের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ পদে ডাম্পিং করা হয়েছে। অথচ এ পদে তিনিই যোগ্য কর্মকর্তা বলে বিবেচিত হলেও বিমান তাকে বঞ্চিত করছে। বিমানে এ ধরনের অরাজকতা দেখার কেউ নেই।

সর্বশেষ খবর