রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ্বমানের সেবায় গরিবের ভরসা

বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন হাসপাতাল

জয়শ্রী ভাদুড়ী


বিশ্বমানের সেবায় গরিবের ভরসা

চিকিৎসা সেবা দিতে ব্যস্ত বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন হাসপাতালের চিকিৎসকরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সফেদ দেয়াল ঘেঁষে দোল খাচ্ছে নিম পাতার বিশুদ্ধ বাতাস। পাশেই পরিচ্ছন্ন সাদা চাদরে মোড়ানো বিছানায় শুয়ে আছেন তন্বী (১৯)। হাতে ফোঁড়ানো ক্যানোলা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় শরীরে প্রবেশ করছে স্যালাইন। চিকিৎসার সামর্থ্য না থাকায় জেনেশুনে তন্বী শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন অ্যাপেনডিক্সের ইনফেকশন। এভাবে আর কত দিন! মঙ্গলবার গভীর রাতে ব্লাস্ট হয়ে যায় অ্যাপেনডিক্স। প্রতিবেশীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন দিতেই মুহূর্তে ছুটে আসে বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স। জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হলে পরিবারের অসহায়ত্বের কথা শুনে পাশে দাঁড়ায় হাসপাতাল। তন্বীর অপারেশন থেকে শুরু করে ওষুধ, খাবার সম্পূর্ণ খরচ বহন করছে হাসপাতাল। শুধু তন্বী নন, হতদরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছে বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালের ৩০০ শয্যার মধ্যে ১০০ শয্যা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে দরিদ্র-অসহায় মানুষের জন্য। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠেছে হতদরিদ্র মানুষের আস্থার এই হাসপাতাল। হাসপাতালের পরিচালক ডা. নাহিদ ইয়াসমিন বলেন, ‘সামর্থ্যবানদের জন্য অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু গরিবের চিকিৎসা আর সেবার মান নিয়ে কখনো ভাবে না কেউ। হাসপাতালকে অনেকেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান মনে করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি। ছয়টি হাসপাতালের পাশাপাশি রংপুরেও আদ্-দ্বীন হাসপাতালের আরেকটি শাখা খোলার ইচ্ছা আছে আমাদের।’ মানুষের সেবায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপ এই হাসপাতাল পরিচালনায় সার্বিক সহযোগিতা করছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এই শিল্পগোষ্ঠীর সহযোগিতায় আরও সুদূরপ্রসারী হচ্ছে হাসপাতালের সেবার মান। আকিজ গ্রুপের আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনকে সঙ্গে নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের সাহায্যে বিশ্বমানের সেবায় পৌঁছাচ্ছে এই হাসপাতাল। হাসপাতালের মূল ফটক পেরোতেই দেখা মেলে হাকিম-সাথী দম্পতির। সাথী সাত মাসের গর্ভবতী। তাই স্ত্রীকে নিয়মিত চেকআপ করাতে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন হাকিম মোল্লা। সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম সন্তান আরিয়ানের বয়স এখন তিন বছর। ওর সিজার থেকে শুরু করে যাবতীয় চিকিৎসায় এই হাসপাতালই আমাদের ভরসা। সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়ে চাকরি গেছে। মুদি দোকানের আয় দিয়ে ঢাকার নামিদামি হাসপাতালে ভর্তি করানো সামর্থ্য আমাদের নাই। এই হাসপাতালে সেবা নেওয়ার পরে অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাওয়ার আগ্রহও নাই।’ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ সাজানো আম, জাম, কাঁঠাল, নিম, পেয়ারা আর বিভিন্ন বাহারি পাতার গাছের সবুজ চাদরে। হাসপাতালের প্রশাসন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন শাখার ব্যবস্থাপক তারিকুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘হাসপাতালে ঢুকতেই রোগীদের প্রথম কাজ নিবন্ধন করা। বহির্বিভাগের নতুন রোগীরা মাত্র ২০ টাকার রেজিস্ট্রেশন ফি ও ৫০ টাকার চিকিৎসক ফি দিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে। আর দরিদ্র রোগীদের জন্য রয়েছে ফ্রি সেবা। এই হাসপাতালে কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বিক্রমপুর, যাত্রাবাড়ী, শ্রীনগর, চুনকুটিয়া, বাবুরাপাড়া, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগী আসে। গর্ভবতী চিকিৎসা, নরমাল ডেলিভারি ও সিজার এবং শিশুর সেবায় এই হাসপাতাল ইতিমধ্যেই রোগীদের মধ্যে আস্থার জায়গা অর্জন করেছে। শিশুদের টিকাদান কার্যক্রমে একবার ২০ টাকা ফিতে নিবন্ধন করলে টিকার পুরো পর্যায় সম্পন্ন করা হয় বিনামূল্যে।’ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. ওয়াহিদা হাসিন বলেন, ‘প্রতিদিন এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসেন প্রায় ৬০০ রোগী। ২০১৫ সালের জুন থেকে গত বছর এপ্রিল পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮৯৪ জনকে। এই সময়ের মধ্যে ১ হাজার ৭৮৮ জন গর্ভবতীর সিজার সেবা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে গত বছর পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ফ্রি সেবা ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়েছে ২৩ হাজার ৮১৩টি। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের জন্য আমাদের হাসপাতালে বিনামূল্যে ক্লাস করানো হয়। তাদের নিয়ে বৈঠকও করা হয়। কীভাবে নিজের পুষ্টি ও শিশুর পুষ্টি বজায় রাখতে হবে, কীভাবে ও কত দিন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কোন অসুখের কী উপসর্গ এসব প্রাথমিক বিষয়ে মায়েদের শিক্ষা দেওয়া হয়। যাতে মায়েরা সচেতন হন এবং পরিবার সুরক্ষিত থাকে।’ হাসপাতালের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে পরিচ্ছন্নতা আর মমতার ছোঁয়া। হাসপাতালে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের। হাসিমুখে সেবা দেওয়াকে ব্রত করে কাজ করে চলেছেন এখানকার নার্সেরা। হাসপাতালের জন্মলগ্ন থেকে কাজ করছেন রিসিপশন ইনচার্জ শাহিনা খাতুন। হাসপাতালের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালের কাজ যখন শুরু করি তখন থেকে সব নার্স, আয়া, পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রথম কাজ ছিল রোগীদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা। মানুষ অসহায় অবস্থায় হাসপাতালে আসে। তাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে কথা বললে তারা স্বস্তি পায়, আস্থা পায়। আমরা মনে করি কথা বলাও একটা সার্ভিস। আর হাসপাতালের সপ্তম তলায় নার্সদের থাকার ব্যবস্থা করায় জরুরি বিভাগে দ্রুত সেবা দিতে পারি।’ মায়ার খানিকটা অংশ ছড়িয়ে পড়েছে হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ায়ও। তাই তো নাম রাখা হয়েছে ‘মায়ের ছোঁয়া ক্যাফেটেরিয়া’। ছয় তলায় চলছে রোগী ও হাসপাতালের স্টাফদের রান্নার ব্যবস্থা। রোগীদের রান্নার জন্য রয়েছে আলাদা বাবুর্চি ও মেন্যু। পুষ্টিগুণ ঠিক রেখে ঝাল, মসলা কম দিয়ে রান্না করছেন আবুল হোসেন। এই রান্নাঘরের বৈশিষ্ট্য হলো সবার আগে পরিচ্ছন্নতা। সবকিছু মিলিয়ে নির্মল পরিবেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছে গরিবের হাসপাতাল আদ্-দ্বীন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর