রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বাস্তবতার বিলেত ৫

ড্রাগ ক্যাপিটাল, বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেট

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

ড্রাগ ক্যাপিটাল, বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেট

ব্রিটেনের বাংলা টেলিভিশনগুলোয় প্রতিদিন যে ইসলামিক সওয়াল ও জওয়াবের লাইভ অনুষ্ঠান হয় অথবা বিভিন্ন মানবিক ও ধর্মীয় প্রজেক্টের জন্য ফান্ড রেইজ করা হয় সেখানে প্রচুর কল আসে বাংলাদেশিদের। এর বড় একটি অংশ টেলিভিশনে মানুষের কাছে দোয়া চান তাদের মাদকাসক্ত সন্তানের সুস্থতা বা সঠিক রাস্তায় ফিরে আসার জন্য! মানুষ কতটা নিরুপায় হলে টেলিভিশন লাইভে এসে সন্তানের সুবুদ্ধির জন্য দোয়া চান! প্রতি বছর যখন ও লেভেল বা এ লেভেলের রেজাল্ট বের হয় তখন টাওয়ার হ্যামলেটসে বসবাসরত বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের ঈর্ষণীয় সাফল্য সবাইকে গর্বিত করে। সেই টাওয়ার হ্যামলেটই আবার যখন ব্রিটেনের ড্রাগ ক্যাপিটালের মর্যাদা পায় তখন লজ্জায় মাথা নোয়াতে হয়। মুদ্রার এক পিঠে যেমন রয়েছে বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের সাফল্যগাথা, তেমনি অন্য পিঠে রয়েছে রূঢ় বাস্তবতা! সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে। সম্প্রতি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০১৬-২০১৯ সালের যে পরিকল্পনা রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে সেই রিপোর্টে এসেছে লক্ষাধিক বাংলাদেশি অধ্যুষিত এই এলাকার মাদকের ভয়াবহ চিত্র।

৮ বর্গমাইল এলাকায় ৩ লাখ মানুষের বাসস্থান টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বছরে ২ হাজার ৫০০-এর মতো ড্রাগসংক্রান্ত ক্রাইম ঘটে; যা গড়ে প্রতি মাসে ২০০-এরও বেশি। শুধু ড্রাগসংক্রান্ত ক্রাইমের কারণে লন্ডনের ৩২টি বারাহর মধ্যে টাওয়ার হ্যামলেটস পঞ্চম! সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ৭ হাজারের মতো কোকেন গ্রহণকারী রয়েছেন টাওয়ার হ্যামলেটসে! এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, বছরে অন্তত ৬০০-এর মতো ড্রাগ ডিলার বা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতকে আটক করা হয়। গত জুলাইয়ে ব্রিটেনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির রিপোর্টে বলা হয়েছে, বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন পাউন্ডের ড্রাগ স্মাগলিং হয় ব্রিটেনে। ব্রিটেনে বছরে শুধু হেরোইন আসে ২৫ টন আর কোকেন ৩০ টন! সন্ধ্যার পর ইস্ট লন্ডনের বিভিন্ন অন্ধ গলির রাস্তাঘাটে দেখা যায় তরুণ প্রজন্ম কীভাবে মাদকে ডুবে থেকে। শুধু যে ছেলেরা তা নয়, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মা-ও আসক্ত। অনেক মেয়ে শুধু ড্রাগের টাকা জোগাড় করার জন্য নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন। অনেক বাংলাদেশি কিশোরী ড্রাগের টাকার জন্য ড্রাগ বিক্রির কাজ করে! অনেকেই গ্যাংয়ের ট্র্যাপে পড়ে যৌন হেনস্তার শিকার হয়। ইস্ট লন্ডনের একজন ড্রাগ ডিলারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাঁজা, হেরোইন, কোকেনের পাশাপাশি বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় ড্রাগ হচ্ছে লাফিং গ্যাস নেওয়া। তিনি জানান, ড্রাগ ডিলিং খুব রিস্কের কাজ হলেও খুব সহজে বিশাল অঙ্কের টাকা কামানো যায় বলে তিনি এই ব্যবসায় জড়িত। তবে তিনি স্ট্রিট সেলার। তার ওপরে রয়েছে আরও অনেক ধাপ। সম্প্রতি বিজনেস ইনসাইডারের এক রিপোর্টে বলা হয়, কলম্বিয়ায় ১ কেজি কোকেনের দাম পড়ে ২ হাজার পাউন্ড (২ লাখ বাংলাদেশি টাকা)। সেটা ব্রিটেনের রাস্তায় বিক্রি হয় প্রায় ৫৫ হাজার পাউন্ডে (৫৫ লাখ বাংলাদেশি টাকা)! স্টেপনিগ্রিন এলাকার ১৯ বছরের ছেলে সামিউন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কোকেনে আসক্ত! জানান, স্কুলে থাকতে কৌতূহলবশে সিগারেট, এরপর গাঁজা। সেখান থেকে এখন কোকেনে আসক্তি। প্রতিদিন তার ৫০ পাউন্ডের কোকেন লাগে! এই টাকার জোগান নিতে তিনি প্রায়ই নানা ধরনের ছিনতাই ও চুরি করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা জানান, তার ছেলের বয়স ২৫। ছেলে অত্যধিক অশান্তি করে তাই তিনি নিজেই ছেলের জন্য ড্রাগ কিনে এনে দেন। তিনি বলেন, ‘আমি কিনে না দিলে ঘরে ভাঙচুর করে, আমাকে মারে! বাইরে গিয়ে চুরি-চামারি করে!’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, এক দিন ছেলে তার গলায় দা ধরেছিল টাকার জন্য! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ভুক্তভোগী মায়ের মতো শত শত বাংলাদেশি পরিবারের চোখের জল গালে শুকায় শুধু ড্রাগাক্রান্ত সন্তানের কারণে! ড্রাগ আসক্তির কারণে ইস্ট লন্ডনের বিভিন্ন রাস্তায় দিনদুপুরে অনেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছিনতাই করেন। এদের টার্গেট থাকে সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন সেট, ক্যাশ টাকা। এর জন্য খুব খারাপ ভাবে আঘাত করতেও বাধে না তাদের। ২০১৫ সালে সালমন লেনে বাসার সামনে এভাবে আক্রমণের শিকার হন সাংবাদিক-কলামিস্ট জুয়েল রাজ। বাংলাদেশি ছয়-সাত জন কিশোর এলোপাতাড়ি আক্রমণ করে মোবাইল ফোন সেট ও সঙ্গে থাকা ২ হাজার পাউন্ড ক্যাশ নিয়ে যায়। এ রকম ঘটনা টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে নিত্যদিনের। শুধু সন্তানদের ড্রাগ থেকে বাঁচানোর জন্য অনেকেই টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্যান্য কাউন্সিলে। গত কয়েক বছরে ২০০ থেকে ৩০০ পরিবার বাইরে চলে গেছে শুধু ইস্ট লন্ডনের পরিবশেগত কারণ দেখিয়ে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র জন বিগস গত জুলাইয়ে নতুন ১৪ জন পুলশ নিয়োগ করেছেন শুধু মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অসামাজিক ব্যবহার বন্ধের জন্য। তিনি বলেন, ‘দেড় মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করেছি শুধু নতুন ১৪ জন পুলিশ নিয়োগের জন্য। আমি বাসিন্দাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য।’ টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বারাহ কমান্ডার উইলিয়াম স্যুই বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ করে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দেওয়াই আমাদের প্রথম কাজ।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর