রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
হাওরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম

ফেঁসে যাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা

মোস্তফা কাজল

সুনামগঞ্জে হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণে দায়িত্ব অবহেলা ও অনিয়মের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ প্রস্তুত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগগুলো চূড়ান্ত হলে পাঠানো হবে মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে দুদকের কাছে অভিযুক্তদের বিষয়ে পয়েন্ট আকারে তথ্য-প্রমাণ চাওয়ার পর অভিযোগগুলো তৈরি শুরু হয়েছে।

দুদক জানায়, চলতি বছরের ২ জুলাই হাওরে ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে ৬১ জনকে আসামি করে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। একই সঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে দুদকের অনুসন্ধান টিম। ইতিমধ্যে প্রকৌশলী ও ঠিকাদারসহ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে দুদক। দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলে মন্ত্রণালয় তাদের অভিযোগনামা চেয়েছেন। আমাদের তদন্ত টিম মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুসারে অভিযোগনামা তৈরি করছেন। এর আগে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটি যদি যথাসময়ে কমিশনে পাঠানো হতো, তা হলে হয়তো হাওরের বিপর্যয় ঠেকানোর চেষ্টা আরও দৃঢ় হতো। গত ২৪ মে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে গেলে দুদক চেয়ারম্যানকে হাওর অঞ্চলের দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় বলে জানা যায়। দুদক সূত্র জানায়, হাওর রক্ষাবাঁধে ফাটল ও কোথাও বাঁধ ভেঙে হাওর তলিয়ে যাওয়ার পেছনে পাউবোর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে মতো দুদকের একজন মহাপরিচালক কাদের দুর্নীতির কারণে হাওরের বাঁধ ভেঙে কৃষকের সর্বনাশ হচ্ছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়ার পর মন্ত্রণালয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে কমিটি করার জন্য বলে। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত বছর এপ্রিলে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে। প্রতিবেদনটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে দুদকে আসে। কিন্তু এতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বাঁধ ভেঙে কৃষকের ফসলহানির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলা হয়, বন্যা, আগাম বৃষ্টি ও ইঁদুরে বাঁধ কেটে দেওয়ার কারণে হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকে। ওই তদন্ত কমিটি দুর্নীতির কথা গোপন করায় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ আনে দুদক। হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়া নিয়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তারা দুর্নীতির ঘটনা স্বীকার করে নেন। জানা গেছে, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৩৬টি হাওর রক্ষায় ৪৫ থেকে ৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে দুদকের পরিচালক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম হাওর এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তারা সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আসেন। ৭৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশসহ কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৬১ জনের নামে দুদক মামলা করেন। এ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ১৩ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন—পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (উন্নয়ন-১, হাওর) নুজহাত ইয়াসমিন, যুগ্ম প্রধান (পরিকল্পনা অনু বিভাগ) মন্টু কুমার বিশ্বাস, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিওন) এ কে এম মমতাজ উদ্দিন। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট কমিটির সাতজন হলেন—যুগ্ম সচিব কাজী ওবায়দুর রহমান, শামিম আরা খাতুন, মো. খলিলুর রহমান, উপসচিব নন্দিতা সরকার, মুহম্মদ হিরুজ্জামান, সহকারী প্রধান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ রাসেল ও মো. সিদ্দিকুর রহমান। দুদকের সুপারিশে বলা হয়েছিল, ১৩ কর্মকর্তা সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণকাজ যথা সময়ে শুরু ও শেষ করার ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধান, পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়িত্ব পালনে সীমাহীন অবহেলার কারণে বন্যার পানি ঢুকে হাওরে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বলা হয়, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী সিনিয়র সচিব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান। অধস্তন কার্যালয়গুলোর প্রধান হিসাবদানকারী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট দফতর, অধিদফতরের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে যথাসময়ে সুষ্ঠুভাবে ব্যয় হয় তা নিশ্চিত করবেন। এ ক্ষেত্রে পাউবোর ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ৫৬ দিন পর। একই সঙ্গে পাউবোর আওতাধীন প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট কমিটি নিবিড়ভাবে তদারক করেনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর