মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কারিশিল্পের ধসে সরকার মালিক দুই পক্ষই দায়ী

বাস্তবতার বিলেত শেষ

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

কারিশিল্পের ধসে সরকার মালিক দুই পক্ষই দায়ী

ব্রিটেনে ১৩ হাজার রেস্টুরেন্টের মধ্যে ১০ হাজারের মালিকানা বাংলাদেশিদের! ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বাংলাদেশি কারি শিল্পের অবদান বছরে ৫ বিলিয়ন পাউন্ড। হোম অফিসের বেশকিছু সিদ্ধান্ত এই শিল্পের বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শেফ আনার ব্যাপারে সরকারের যে নিয়ম-নীতি, বিশেষ করে বেতনের ব্যাপারে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া অবৈধ কর্মী ধরার ছুতোয় প্রায়ই রেস্টুরেন্টে ইমিগ্রেশন পুলিশ হামলা চালায়। এই নানা সমস্যার কারণে প্রতিদিনই ব্রিটেনের কোনো না কোনো শহরে বন্ধ হচ্ছে বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্ট ও টেকওয়ে। এসব নিয়ে সরব এখানকার বিভিন্ন সংগঠন। সারা বছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে, স্থানীয় এমপিদের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে সরকারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান রেস্টুরেন্টের মালিকরা! তবে যে কথাটি কেউ বলেন না তা হলো, এই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে কি শুধুই সরকারের দোষ? রেস্টুরেন্টে কাজ করেন অথবা করতেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেল অন্য এক চিত্র! প্রচুর রেস্টুুরেন্ট রয়েছে, যাদের মালিকদের ব্যবহারের কারণে বর্তমানে সেগুলোয় কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে মানুষ। ‘লন্ডনে রেস্টুরেন্টে কাজ করলে আপনি দক্ষ কর্মী হতে না পারলেও রাজনীতিতে দক্ষ হতে পারবেন!’ কথাগুলো মজার ছলে বলছিলেন দীর্ঘদিন ধরে রেস্টুুরেন্টে তান্দুরি শেফ হিসেবে কাজ করা মিলাদ হোসেন। তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টে কাজ যে করেনি, সে দুনিয়া কী জিনিস বুঝবে না! মিলাদ জানান, তিনি যে রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন সেখানে কিচেনে চারজন আর সামনে কাস্টমার সার্ভিসে তিনজন কাজ করতেন। মালিকের মন জুগিয়ে চলার জন্য চলত নানা পলিটিকস! রেস্টুরেন্টের মালিক এতই কৃপণ ছিলেন যে যদি কোনো দিন স্টাফরা একটু ভালো কিছু খাওয়ার জন্য রান্না করতেন তাহলেই গজব ফেলতেন মালিক। স্টাফদের জন্য কম দামে শুধু হাড্ডিওয়ালা মাংশ কিনে আনতেন তিনি। মিলাদ পাঁচ বছর হলো ট্যাক্সিতে চলে এসেছেন।

আরেফিন নামে একজন ওয়েটার বলেন, ‘মালিকদের ব্যবহার এত খারাপ যে বলার মতো না। পান থেকে চুন খসলে নানা টিপ্পনী আর বাজে কথা শুনতে হয়। কাস্টমারকে ভালো সার্ভিস দিলাম আমি, কাস্টমার যদি খুশি হয়ে আমাকে টিপস দেন, সেই টিপসও মালিক নিয়ে নেন!’ শাম রহমান নামে একজন শেফ বলেন, ‘বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি। সাত বছর ঈদের দিনও ছুটি পাইনি!’ উল্লেখ্য, ঈদের দিনও ব্রিটেনে বেশির ভাগ রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে। মূলত অনেক রেস্টুরেন্টের মালিকের ব্যবহার, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি কারণে ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ-বাংলাদেশি প্রজন্ম রেস্টুরেন্টে কাজ করতে আগ্রহী নয়। আর অবৈধ কর্মী দিয়ে কাজ করালে যদি পুলিশের তল্লাশি পড়ে তাহলে প্রতি অবৈধ কর্মী হিসেবে ২০ হাজার পাউন্ড বা ২১ লাখ বাংলাদেশি টাকা জরিমানা গুনতে হয় মালিকদের।

ব্রিটিশ সরকার একসময় বাংলাদেশ থেকে ওয়ার্ক পারমিটের আওতায় রেস্টুরেন্টের কর্মী আনার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগের অপব্যবহার করে সে সময় অনেকেই প্রতি ওয়ার্ক পারমিট ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। অনেকেই সে সুযোগে নিজের ভাই-ভাতিজাকে বিলেতবাসী করেছেন। কিন্তু দক্ষ কর্মী খুব কমই এসেছেন। একসময় হোম অফিস বুঝতে পারে ওয়ার্ক পারমিটের নামে অপব্যবহার। তাই এতে কড়াকড়ি আরোপ করে। বর্তমানে একজন শেফ বাংলাদেশ থেকে আনতে হলে মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বেতন দিতে হবে বলে হোম অফিস নিয়ম করেছে। কিন্তু ব্রিটেনে স্থানীয় একজন দক্ষ শেফের বেতন স্থান ও রেস্টুরেন্টের ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে এক লাখ ৬০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রেস্টুরেন্ট মালিক বলেন, এত উচ্চ বেতন দিয়ে শেফ রাখা সম্ভব নয়। তাই আগের নিয়মে বাংলাদেশ থেকে কম বেতনে কর্মী আনার সুযোগ করে দিতে হবে। শামসুল আবেদীন নামের একজন বলেন, ‘যারা রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন তাদের বেশির ভাগেরই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমার পরিচিত বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যারা রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন তাদের কাছে এসব অভিজ্ঞতা শুনে ভয়ে কোনো দিন আর রেস্টুরেন্টমুখী হইনি কাজের জন্য।’ আনফর মিয়া নামের একজন রেস্টুরেন্ট মালিক বলেন, ‘আমাদের রেস্টুরেন্ট নেতারা শুধু সরকারকে চাপে রাখায় ব্যস্ত! কিন্তু আমাদের মধ্যেই অনেকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সুনাম ক্ষুণ্ন করছেন তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কোনো কাজ করছেন না।’ আনফর মিয়া বলেন, ‘আমি নিজে একজন রেস্টুরেন্ট মালিক। আমি মনে করি এই কারি ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের পেছনে শুধু সরকারের কড়া ইমিগ্রেশন নীতি নয়, আমাদের মতো মালিকদেরও দমন-পীড়ন নীতি রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর