বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিএসটিআইর টোকেন বাণিজ্য তুঙ্গে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএসটিআইর টোকেন বাণিজ্য তুঙ্গে

সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক সার্জেন্টদের মতো এবার বিএসটিআই-এও টোকেনবাণিজ্য শুরু হয়েছে। অবৈধ কারখানার উৎপাদন ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত নির্বিঘ্ন রাখাসহ মোবাইল কোর্টের অভিযানমুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতিতে চলছে এ চাঁদাবাজি। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি সিন্ডিকেট বিএসটিআইর মনোগ্রাম ছাপানো কাগজে কারখানার নাম ও মাসিক চাঁদার রেট লিখে তা টোকেন হিসেবে ব্যবহার করছে। টোকেনের বিপরীতে নকল কারখানা ও ভেজাল পণ্য বাজারজাতকারীদের থেকে লাখ লাখ টাকা মাসোয়ারা আদায় করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে নানা কৌশলে বেশকিছু ‘মাসোয়ারার টোকেন’ সংগ্রহ করা গেছে। প্রতিটি টোকেনের সঙ্গেই বিএসটিআইর একাধিক সহকারী পরিচালকের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মাঠপর্যায়ে টোকেনবাণিজ্য চুপিসারে পরিচালিত হলেও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) দফতরে তা ওপেন সিক্রেট। টোকেনের মাসোয়ারা বাণিজ্যটি বিএসটিআইর কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কাছে আকর্ষণীয় ‘প্যাকেজ’ হিসেবেই সমাদৃত। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঘুপচি-বস্তি বা আবাসিক ফ্ল্যাটে যতই গোপনে নকল কারখানা বসানো হোক না কেন—বিএসটিআইর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নেই। অনুমোদনহীন এসব নকল কারখানা থেকে প্রতি মাসে সোর্সদের মাধ্যমে প্রায় আড়াই কোটি টাকা মাসোয়ারা আদায় হয়ে থাকে। সেসব মাসোয়ারার টাকা বিএসটিআইর কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্ধারিত হারে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। মাসোয়ারা আদায়ের জন্য রাজধানীজুড়ে শতাধিক সোর্স সমন্বয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছে তারা। সোর্সরা বিভিন্ন মহল্লা অলিগলি ঘুরে নকল অবৈধ কারখানাগুলোর তালিকা সংগ্রহের পর সেসব কারখানা মালিকদের ডাক পড়ে বিএসটিআই দফতরে। সেখানে কথাবার্তা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর মাসোয়ারার টাকা লেনদেন হয় রামপুরার একটি বাসায়। একাধিক সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী-রাজধানীতে শুধু ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট বেকারি কারখানা আছে তিন হাজারেরও বেশি। এগুলোর কোনোটারই অনুমোদন নেই। পানি বোতলজাত ও সরবরাহের কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে পাঁচ শতাধিক মিনি কারখানা। আছে অবৈধ বৈদ্যুতিক তার তৈরি, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, বৈদ্যুতিক পাখা উৎপাদনের নকল কারখানার সংখ্যাও কয়েক শ। অন্যদিকে নকল পারফিউমসহ সব ধরনের প্রসাধনী তৈরির জন্য পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, সূত্রাপুরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে সহস্রাধিক অবৈধ কারখানা। এসব কারখানার মালিকরা কেউ মাসোয়ারার হাত থেকে রেহাই পান না।

বিভিন্ন ধরনের কারখানায় বিভিন্ন রকম মাসোয়ারা রেট বসানো রয়েছে। মাসোয়ারা পরিশোধের পর ইদানীং নানা প্রতীক চিহ্নিত বিশেষ টোকেন দেওয়ার প্রথাও চালু করা হয়েছে।

কোনো কারখানার অনুমোদন নিতে বা পণ্য উৎপাদনের ছাড়পত্র নেওয়ার ক্ষেত্রে কেউ বৈধপন্থায় বিএসটিআইতে গেলে নানারকম হয়রানির শিকার হন, সময়ক্ষেপণও করা হয় মাসের পর মাস। তা ছাড়া নানা ছুত-ছুতোয় তাদের লাইসেন্স প্রদানের পরিবর্তে হয়রানি করার এন্তার নজির রয়েছে। এক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট লাইসেন্স প্যাকেজ নামে আলাদা একটি প্রথারও প্রচলন শুরু করেছে। কারখানা বা পণ্য উৎপাদনের লাইসেন্স থেকে শুরু করে কেমিক্যাল পরীক্ষা, ছাড়পত্র, অনুমোদনের যাবতীয় কাজ করে দেওয়ার নিমিত্তে সিন্ডিকেট এক ধরনের ঠিকাদারি গ্রহণ করে। এতে কারখানা মালিকরা তার চাহিদামাফিক টাকা জমা দিলে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই লাইসেন্স হাতে পেয়ে যান। বড় ধরনের যে কোনো কারখানা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনসহ সার্বিক প্যাকেজ কাজ সম্পন্ন করতে ৫/৬ লাখ টাকা তুলে দিতে হচ্ছে। পুরাতন ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসার অনুমোদন প্রদান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘোষণার পরও মোটা অঙ্কের বিনিময়ে চুপিসারে একের পর এক কেমিক্যাল সামগ্রী ব্যবহার সংক্রান্ত বিভিন্ন কারখানার লাইসেন্স প্রদান করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

টিপু সুলতান রোডে একটি আবাসিক বাসায় গড়ে তোলা ঢাকা ফুড ইন্ডাস্ট্রিজে তৈরি হচ্ছে ১০/১২ রকমের নকল সামগ্রী। সেখান থেকেও লাখ টাকা মাসোয়ারা আদায়ের উদাহরণ আছে। নবাবপুর এলাকায় ৮৭টি নকল বৈদ্যুতিক তার উৎপাদনের কারখানা থেকে মাসোয়ারা আদায় হয় ২৫ লাখ টাকারও বেশি। এসব কারখানা থেকে মাসোয়ারা তোলার দায়িত্ব পালন করেন জনৈক মনির। ৬টি নকল কারখানার মালিক মনির হোসেন সর্বত্র ‘তার মনির’ হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত। যাত্রাবাড়ী থানার মীরহাজিরবাগ এলাকায় ২০টি নকল বৈদ্যুতিক পাখা কারখানা, ১২টি নকল জর্দার কারখানা। সেখান থেকে বিএসটিআইর টোকেনে চাঁদা তুলে পুলিশ সোর্স ডেঙ্গু ও তার সহযোগীরা। একইভাবে জিনজিরায় ছোরহাব, নবীরউদ্দিন, সাহাদাৎ, চকবাজার-মৌলভীবাজারে ইউসুফ, রাজ্জাক, মনোজকান্তি, কামরাঙ্গীরচরের বিভিন্ন স্থানে আ. জব্বার, শহিদুল, কবির, শান্ত, আজাদসহ সংঘবদ্ধ একটি চক্র বিএসটিআই সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর