লাশ পড়ছে। রক্ত ঝরছে। একের পর এক। চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা। কখনো রেললাইনের ওপর। কখনো রেললাইনের আশপাশে। রাতে দিনে যখন তখন লাশ মিলছে। কিন্তু খুনি চক্রের সন্ধান মিলছে না। বিশেষ করে তেজগাঁও রেল স্টেশনের আশপাশে থেকে লাশ উদ্ধার হচ্ছে বেশি। বেশির ভাগ লাশের চেহারা-শরীর থেঁতলানো। আতঙ্ক চারদিকে। পুুলিশ ও গোয়েন্দাদের তালিকায় তখন সন্ত্রাসীদের প্রথম নামটি ছিল নজরুলের। ছোটখাটো হ্যাংলা-পাতলা গড়নের এই দুর্ধর্ষ এই হিটম্যানকে কখনো পুলিশ পাকড়াও করতে পারেনি। তবে এক সময় বহু খুনের এই নায়ক নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করে প্রাণ হারায়। যাদের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিল, সেই বন্ধুদের হাতের অস্ত্রগুলোই গর্জে ওঠে হঠাৎ। আর তাদের নিশানায় ছিল সে নিজেই। তবে তার মৃত্যু নিয়ে ভিন্ন ধরনের গল্প চালু আছে। অনেকেই বলেন, নিজেদের মধ্যে খুনাখুনির ঘটনায় এমন অনেকেই ছিল, যাদের সঙ্গে পুলিশের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যে কারণে মনে করা হয়ে থাকে, গ্রেফতার না হওয়ায় নজরুলকে ভিন্ন পথে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় তার জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। ১৯৮৫ সালের ঘটনা। তেজগাঁও রেলস্টেশন। পূর্ব দিকে পরিত্যক্ত রেললাইনের পর বেশ কয়েকটি খালি বগি। সেখানেই কাপড়ে চোখ আর দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা এক যুবককে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ৮-১০ জন ঘিরে আছে। তারা অপেক্ষায় তাদের বড় ভাইয়ের জন্য। তিনি আসার পর যুবকটির ব্যবস্থা হবে। সন্ধ্যার পর তাদের সেই বড় ভাই সেখানে এসে পৌঁছলেন। বড় ভাইয়ের হাতে লোহা পেটানোর একটি বড় হাতুড়ি তুলে দেওয়া হলো। চোখ বাঁধা যুবকটি তখন আঁচ করতে পারছিল, তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। প্রাণরক্ষার শেষ চেষ্টায় তার আকুতি, মিনতি করে যাচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতুড়ি হাতে নিয়ে সেই বড় ভাই ধীরে ধীরে চোখ বাঁধা যুবকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। সহযোগীরা যুবকটির হাত-পা চেপে ধরে রেলের পাতের ওপর শুইয়ে দিলেন। এরপরই শুরু হলো সেই বড় ভাইয়ের নিষ্ঠুরতা। যুবকটির হাত ও পা রেলের পাতের সঙ্গে পিষে যাওয়া পর্যন্ত হাতুড়িপেটা করেই যাচ্ছিলেন সেই বড় ভাই। এক সময় হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া যুবকটির লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনের পাশে কিংবা কোনো পরিত্যক্ত বগির ভিতর। সেই বড় ভাইটি হলো নজরুল। পুরো নাম নজরুল ইসলাম। তিনি রেললাইনের ওপর ফেলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে এমনভাবেই অসংখ্য খুন করেছেন। তার নৃশংসতায় অনেকেই এখন পঙ্গু। খুনের জন্য তিনি পিস্তল বা চাপাতি, রামদার চেয়ে হাতুড়ি পছন্দ করতেন। তার অধিকাংশ খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে হাতুড়ি দিয়ে। নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন তার প্রতিপক্ষ আর তেজগাঁও স্টেশন এলাকার অপরাধী। হাতুড়ি পেটানোর এই নজরুল ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গোটা তেজগাঁও এলাকায়। ছোটখাটো দেখতে এই দুর্ধর্ষ অপরাধীকে ভয় করতেন ঢাকার অন্য সন্ত্রাসীরাও। এ ছাড়া তেজগাঁও ফার্মগেট এলাকার সন্ত্রাসীরা তার নৃশংসতাকে ভয় করতেন। নজরুলের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। বাবা ছিলেন রেলওয়ে মাস্টার। তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে তাদের বাসা ছিল। ১৯৮৬ সালে তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে নজরুলের স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কলোনির মাসুদের মারামারি হয়। একপর্যায়ে একজন আরেকজনকে ছোরা বসিয়ে দেয়। এ ঘটনার জের ধরে কলোনির লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা তখন নিত্যদিনকার ঘটনা। স্থানীয়দের উদ্যোগে সেখানে দুই পক্ষের সমঝোতার বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এক সন্ধ্যায় বসে সে বৈঠক। কিন্তু বৈঠক চলাকালে স্টেশন এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাতের আঁধারে বৈঠকেই হামলা চালানো হয়। কুপিয়ে নৃশংসভাবে সেখানে খুন হন মাসুদের বাবা ও ফুফাতো ভাই। এই জোড়া খুনটি পরিকল্পিতভাবেই তখন করা হয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। এই জোড়া খুনের পর থেকেই নজরুল আরও দুর্ধর্ষ হয়ে পড়ে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ভাড়াটে হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও তিনি গুণ্ডামি করেছেন। অস্ত্র চালিয়েছেন। ওই এলাকায় তার ওপর তখন আর কেউ ছিলেন না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, নজরুলের খুনের শিকার একজনের ছেলে হচ্ছেন মাসুদ। এই মাসুদের পরবর্তীতে ছাত্রদলের একজন বড় ক্যাডার হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। যাকে একবার ফার্মগেট এলাকায় কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছিল। বিএনপির খরচে তাকে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা করানো হয়। এরপর থেকে তার নাম হয় ল্যাংড়া মাসুদ। আর এই মাসুদকে কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন সুইডেন আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুল। যাকে পরবর্তীতে আসলাম নিজেই দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে খুন করেন। আর ল্যাংড়া মাসুদ পরে নিহত হন রাজধানীর ডিওএইচএস-এ। মাসুদ হত্যাকাণ্ডেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি গ্রুপের যোগসাজশ রয়েছে।
তেজগাঁও এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নজরুলের অস্ত্রের ভাণ্ডারে প্রচুর অস্ত্র ছিল। কিন্তু তিনি গুলি করার চেয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে পছন্দ করতেন বেশি। পেটানোর জন্য তিনি রাখতেন বড় বড় হাতুড়ি। তার অস্ত্রের ভাণ্ডারেও বড় বড় হাতুড়ি থাকত। তেজগাঁও স্টেশন এলাকা ও তার আশপাশ এলাকায় একের পর এক লাশ পড়ে থাকলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারত না। ১৯৮৯ সালের এক রাতে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের সন্ত্রাসীরা তাকে রেলওয়ে কলোনিতেই এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। তার ওই হত্যার মধ্য দিয়েই অবসান ঘটে নজরুলের শাসন। নজরুলের মৃত্যুর পর সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ান চোরা খালেক। পরে তার মৃত্যু পুলিশের নির্যাতনে।