বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান

ঋণ খেলাপের সংস্কৃতি না থাকলে দেশ আরও এগিয়ে যেত

চার ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঋণ খেলাপের সংস্কৃতি না থাকলে দেশ আরও এগিয়ে যেত

অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে গতকাল বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ব্যাংকের পক্ষ থেকে বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানকে ক্রেস্ট দেওয়া হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঋণ খেলাপের সংস্কৃতি না থাকলে দেশ আরও এগিয়ে যেত বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। গতকাল রাজধানীর দিলকুশায় এক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বিগত ৩০ বছরে বসুন্ধরা গ্রুপের সবচেয়ে বড় সাফল্য, কোথাও কোনো দিন সুদ মাফ করার কথা বলেনি। কোথাও বলেনি, আমাদের দায়মুক্তি দিন। আমরা সব সময় মানুষের জন্য, দেশের  জন্য কাজ করছি। বাংলাদেশ না হলে আজ আমি এবং বসুন্ধরা গ্রুপ সৃষ্টি হতো না। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমরা সবাই আজকের এই অবস্থানে।’ দিলকুশায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংকটির নেতৃত্বে সিন্ডিকেশনের আওতায় বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (ফ্লাওয়ার মিল ইউনিট-২) অনুকূলে প্রায় ৮৯ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণসুবিধা প্রদানবিষয়ক চুক্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি চারটি ব্যাংক যৌথভাবে এই সিন্ডিকেশন ঋণটি প্রদান করবে। এই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান সংগঠক হিসেবে কাজ করবে অগ্রণী ব্যাংক। এই সিন্ডিকেশনে অংশগ্রহণকারী অন্য তিনটি ব্যাংক হলো— বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক।

নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম, ঢাকা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি ইমরানুল হক, কমার্স ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কাজী রেজাউল করিম ও পূবালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সুলতানা শরীফুন্নাহার। এ সময় অগ্রণী ব্যাংক ও বসুন্ধরা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘সিন্ডিকেশন ঋণ হিসেবে ৮৯ কোটি টাকা বিরাট কিছু নয়। আমরা এককভাবেও এর চেয়ে বড় অর্থায়ন করেছি। এর পরও আমরা খুব উৎসবমুখর পরিবেশে আজকের এই ঋণচুক্তি করছি। কেননা বসুন্ধরা গ্রুপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করপোরেট পথিকৃৎ। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংক বাংলাদেশের আর্থিক খাতের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। বসুন্ধরা গ্রুপের সাফল্যের গল্প নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান অর্জনগুলোও সবার জানা।’

ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের ৯৩৯টি শাখার সব কটিতেই রিয়েল টাইম অনলাইন সেবা পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ করে এই ব্যাংকটি। কোনো মূলধন ঘাটতি নেই। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে অগ্রণী ব্যাংক।’

বর্তমান সরকারের যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে জায়েদ বখত বলেন, এর প্রতিফলন আজকের এই অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর আগে কোনো সরকার একসঙ্গে এতগুলো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করার কথা চিন্তা করতে পারেনি। সেখানে বর্তমান সরকার এই প্রকল্পগুলো যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে দেশের বেসরকারি খাত অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। আর্থিক খাতগুলো অর্থায়নে এগিয়ে আসছে। বেসরকারি খাত থেকেই বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। বেসরকারি খাতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে।

বসুন্ধরা গ্রুপ দেশের সবচেয়ে বড় রিফাইনারি কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছে জানিয়ে অগ্রণী ব্যাংক চেয়ারম্যান বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপ বেসরকারি খাতে বন্দরও তৈরি করতে যাচ্ছে। এখানেও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। করপোরেট খাতগুলো এগিয়ে আসছে। এত দিন রাষ্ট্রীয় খাতগুলোর বদনাম শুনেছি। সেখানে অগ্রণী ব্যাংকের মতো একটি শীর্ষ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বেসরকারি খাতের ব্যাংকও আসছে।’

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ও সিইও শামস্-উল ইসলাম বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর হাবিব ব্যাংক এবং কমার্স ব্যাংক মার্জ করে অগ্রণী ব্যাংক নাম দিলেন। এই নামকরণের মধ্যেই ব্যাংকটির এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা নিহিত ছিল— অগ্রণী অর্থ অগ্রে থাকে যে। তবে সরকারের ব্যাংক হওয়ায় এটি যেমন শক্তিশালী ছিল, তেমন কিছু দুর্বলতাও ছিল। এজন্য ব্যাংকটি ঠিকমতো বেড়ে ওঠেনি। ২০০৭ সালে অগ্রণী ব্যাংক করপোরেটাইজ হয়েছে। নামের সঙ্গে লিমিটেড যুক্ত হয়েছে। এখন অর্থনীতিতে ভালো ভূমিকা পালন করছে ব্যাংকটি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা এককভাবে সরবরাহ করছে অগ্রণী ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংকের এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় আজ আরেকটি পালক যুক্ত হলো, সেটি হলো বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে এই ঋণচুক্তির প্রধান সংগঠন হিসেবে কাজ করা।’ তিনি বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপ আজ যা চিন্তা করে, তা অন্যরা করে আগামীকাল। শিল্প খাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এই গ্রুপ।’

শামস্-উল ইসলাম বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংক দু-একটা লোকের ব্যাংক নয়। এর মালিক ১৬ কোটি মানুষ। এই ১৬ কোটি মানুষ যেন সমৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে, সেই চেতনা আমাদের মধ্যে কাজ করে। আমরা ৪ শতাংশ সুদেও ঋণ দিচ্ছি। সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে হাওর এলাকায় ঋণ দিচ্ছি। ৫ শতাংশ হারে গবাদিপশু পালনে ঋণ দিচ্ছি। ঠিক সেভাবে আমরা শিল্পায়নে ঋণ দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের আটটি প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। আমরা সরকারি আরও চারটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছি।’

বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজের আটা-ময়দা উৎপাদন কারখানায় ঋণ প্রদানের বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘আজকে আমরা এমন একটা প্রকল্পে হাত দিয়েছি, যার সুফল সারা দেশের মানুষ পাবে। তাদের নাস্তার টেবিলে এই সুফল পৌঁছবে। এই প্রকল্পের আরেকটি ইউনিটেও অর্থায়ন করেছি। দেশের প্রায় ৮০টি শিল্প কারখানায় এ ধরনের সিন্ডিকেট ঋণ প্রদান করেছি। আমরা মনে করি, অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও দায়িত্ব ও আস্থা রক্ষা করে চলবেন।’

সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘আজকে আমরা যা সুদ দিচ্ছি, সেটা শ্রেণিকৃত ঋণের কারণে। ওই খেলাপি ঋণের ভার আমাদের ওপর চলে আসছে এবং ব্যাংকগুলোর ওপর চলে আসছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের তো কোনো নিজস্ব টাকা নেই। ১৬ কোটি মানুষের টাকা। আমি আশা করি খেলাপি সংস্কৃতি (ডিফল্ট কালচার) যদি উঠে যায়, ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে যদি এই কালচার উঠে যায়, এই প্রবণতা কমে যায়, বাংলাদেশের আরও অনেক দ্বার উন্মোচিত হবে।’

আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘আমাদের আজকের হাউজিংয়ে সাফল্যের পেছনে অগ্রণী ব্যাংকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এই ব্যাংক থেকে আমরা রিভারভিউ হাউজিংয়ের জন্য ১০৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সেটা দিয়ে আমাদের বিশাল প্রসার ঘটেছে। তখনকার ১০৭ কোটি টাকা আজকের এক হাজার কোটি টাকার সমান। সেই টাকা আমরা পরিশোধ করেছি এবং সেই সময় হাউজিংয়ে ঋণ দেওয়া একটা বিশাল বড় দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল। ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে আমি একমাত্র ঋণগ্রহীতা, যে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি এবং ঋণ ফেরত দিয়েছি।’

বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ১৯৯২ সাল থেকে। সেই থেকে একের পর এক প্রকল্প করতে ঋণ নিয়েছি। প্রথম ঋণটি পেতে একটু অসুবিধা হয়েছে। তার পর থেকে আর আমাদের পেছনে তাকাতে হয়নি। এমনকি আমাকে ব্যাংকেও আসতে হয়নি খুব বেশি। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার আমরা ঋণ নিয়েছি-দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘ফুডেও আমরা দুটি ঋণ নিয়েছি। একটি পরিশোধ হয়েছে। অন্যটিও পরিশোধ হয়ে যাবে।... আজকে আমার এই পর্যায়ে আসার জন্য অগ্রণীসহ যেসব ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকিং করি তাদের অবদান আছে। অগ্রণী ব্যাংক আমার মতো হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করেছে এবং প্রতিদিন করে যাচ্ছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর