শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৬৩

বোরকা পরে খুনিরা লাপাত্তা

মির্জা মেহেদী তমাল

‘হ্যালো, শুনছো! বাসায় মেহমান এসেছে। তুমি বাসায় চলে আসো তারাতারি। দেরি করো না। আসার সময় পোলাওয়ের চাল আর কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে আসবা।’ স্ত্রীর এমন ফোন পেয়ে কাজ শেষ না করেই বাসার দিকে রওনা হন ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন। বাসার সামনে পৌঁছামাত্র আবারও স্ত্রীর ফোন। ‘হ্যালো, বলো। আমি বাসার কাছে চলে এসেছি। সব কিছু এনেছি।’ গিয়াসউদিন ফোন কেটে বাসায় ঢুকেন। ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে কলিং বেল বাজান। ভিতর থেকে দরজা খুলে দেন স্ত্রী লীনা। ‘এই নাও তোমার পোলাওয়ের চাল আর কোল্ড ড্রিংকস। কোথায় কারা এসেছেন?’ ভিতরে ঢোকার আগেই গিয়াসউদ্দিনের প্রশ্ন। ‘আরে আগে ভিতরে ঢোক। দেখ স্পেশাল গেস্ট অপেক্ষায়।’ স্ত্রী লীনা বলতে বলতে দরজা থেকে একটু সড়ে গিয়ে গিয়াসউদ্দিনের জন্য যায়গা করে দেয়। গিয়াসউদ্দিন ভিতরে ঢোকার পরই দরজায় লক করে লীনা। এ সময় ঘরের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা লম্বা ছোরা হাতে একজন পেছন থেকে গিয়াসউদ্দিনের মাথায় আঘাত করে। মাথায় হাত দিয়েই বসে পড়েন গিয়াসউদ্দিন। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। রুমের ভিতর লুকিয়ে থাকা আরও দুজন গিয়াসউদ্দিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলোপাতাড়ি কিলঘুষি। গলায় চেপে ধরে। স্ত্রী লীনা দৌড়ে যেয়ে টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। সোফার একটি কুশন নিয়ে আসে। রক্তাক্ত ছোরা হাতে থাকা ব্যক্তির কাছে দিয়ে বলে, ‘ছোরাটা আমার হাতে দাও। আর এই কুশন দিয়ে ওর নাকমুখে চেপে ধরো। আর এই, তোমরা দুজনে হাত-পা ভালো করে ধরে থাক।’ কুশন দিয়ে গিয়াসউদ্দিনের মুখে চেপে ধরে সেই ব্যক্তি। লীনা নিজেই ছোরাটি হাতে নেয়। স্বামী গিয়াসউদ্দিনের শরীরের ওপর চড়ে বসে। ছোরাটি এলোপাতাড়িভাবে শরীরে চালাতে থাকে। মাথায়, গলায়, বুকে। যেভাবে পেরেছে সেভাবেই ধারালো ছোরাটি বসিয়েই যাচ্ছে। রক্ত ঝরচ্ছে। পিচকিরির মতো ছুটে আসা সেই রক্ত লীনার চেহারায় ভরে যাচ্ছে। এরপরেও থামছে না। বাম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে কপালে লাগা রক্ত মুছে নেয় লীনা। একসময় রক্তাক্ত গিয়াসউদ্দিনের শরীর প্রচণ্ড শক্তিতে ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। কিন্তু চারজন মিলে তাকে চেপে ধরে রাখে। গোঙ্গানোর শব্দ। ধীরে ধীরে নিথর দেহে পরিণত হন গিয়াসউদ্দিন। ভয়ঙ্কর এই খুন করতে তারা সময় নেন মাত্র পাঁচ মিনিট। চারজনই ক্লান্ত। লীনা উঠে দাঁড়ায়। তাদের কোল্ড ড্রিংকস খুলে দেয়। কোক পান করে ওয়াশ রুমে যায় তিন খুনি। নিজেদের পরিষ্কার করে নেয়। এরপর লীনা তাদের বোরকা দিয়ে বলে, ‘তোমরা নিজেদের আড়াল করতে বোরকা পরে চলে যাও। বাকিটা আমি সামলাচ্ছি। যাওয়ার আগে আমার হাত বেঁধে দাও।’ লীনার কথা মতো তিন খুনি তাকে বেঁধে ফেলে। বোরকা পরে বেরিয়েই লাপাত্তা। ফ্ল্যাট থেকে লীনার চিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও! আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। বারান্দার দরজার ওপাশে আটকে রাখা দুই সন্তানও তখন কাঁদছে। তারাও দরজা ধাক্কাচ্ছে ভয়ে। দুই সন্তানকে বারান্দায় আটকে রাখা হয়েছিল খুনের আগে থেকে। চিৎকার শুনে ছুটে আসে সবাই। উদ্ধার হয় লাশ। তদন্তে মাঠে নামে পুলিশ আর গোয়েন্দারা। ঘটনাটি ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের। ওই বছর ১৯ অক্টোবর রাতে মিরপুর ১০ নম্বর সি ব্লকের ১৫ নম্বর লেনের ১১ নম্বর বাসার পঞ্চমতলার ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিনকে। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে অসম প্রেমের ভয়ঙ্কর নৃশংসতার অজানা কাহিনী। পরকীয়ায় মত্ত স্ত্রী লীনা তার কিশোর বয়েসী প্রেমিক ও তার দুই বন্ধুকে নিয়ে খুন করেন স্বামীকে। খুনের ঘটনাটি ডাকাতি বলেই চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল লীনার। আশা ছিল খুন করে ঘর বাঁধবে প্রেমিকের সঙ্গে। কিন্তু মনের সেই আশা পূরণ হয়নি। খুনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধরা পড়ে যান খুনি স্ত্রী লীনা। পাকড়াও হয় তার কিশোরপ্রেমিক মিরপুরের বিএন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র তানভীর (১৮)। তানভীরের অপর দুই বন্ধু ঢাকা বিজ্ঞান কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র জিসান (১৮) ও কর্মাস কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মুক্তকেও (১৮) পুলিশ গ্রেফতার করে। ২০০৩ সালে গিয়াস ও লীনার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। এ দম্পতির ঈশিকা আক্তার (৯) ও নেহাল (৪) নামে দুই সন্তান রয়েছে। নিহতের বাবার নাম হাজী সিরাজ উদ্দিন মাতবর। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে গিয়াস ছিলেন পঞ্চম। গিয়াস গার্মেন্ট এক্সেসরিজের ব্যবসা করতেন। মিরপুর ১০ নম্বরে তার দোকান রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর গিয়াসের বাবা হাজী সিরাজ উদ্দিন মাতবর বাদী হয়ে গিয়াসের স্ত্রী লাভলী আক্তার লীনা ও অজ্ঞাত তিন-চারজনকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে লীনা, তানভীর, মুক্ত ও জিসানকে আসামি করে চার্জশিট দেয় পুলিশ। আসামিদের স্বীকারোক্তি ও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে গিয়াস উদ্দিনকে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ওই কিলিংমিশনে অংশ নেয় চারজন। লীনার প্রেমে পড়ে তানভীর তার (লীনা) পরামর্শ ও উৎসাহে গিয়াসকে খুন করেছে। এ জন্য লীনা তাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। যার মধ্যে ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছে। জিসান ও মুক্ত হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় তানভীরের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে। লীনার টাকায় খুনের সময় পরার জন্য গ্লাবস, গেঞ্জি ও ট্রাউজার কেনে। লীনা নিজেই কিনে দেয় ছুরি। খুনের কৌশল ও পরবর্তী ঘটনা কীভাবে সাজাবে তাও শিখিয়ে দেয় লীনা। খুন শেষে তিন কলেজ ছাত্রই তাদের বাসায় ফিরে স্বাভাবিক ছিল। লীনাকে পুলিশ আটক করার পর তানভীর কয়েকবার থানার সামনেও ঘোরাঘুরি করেছে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে থানার ভিতরে থাকা লীনাকে দেখার চেষ্টা করেছে। তানভীরের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, ঘটনার বছরখানেক আগে গিয়াস উদ্দিনের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তানভীরকে হাই-হ্যালো দেয় লীনা। কয়েকদিন পর একটি কাগজে লীনার মোবাইল নম্বর লিখে রাস্তায় ফেলে রাখে। সেই কাগজ তুলে নেয় তানভীর। এরপর তারা প্রতিদিন কথা বলতে থাকে। কয়েকদিন পর তারা মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে ফুচকার দোকানে দেখা করে। লীনা নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দেয়। তার বাসায় গেলে দুই সন্তান তার ভাইয়ের বলে পরিচয় দেয়। পরে একদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে লীনা নিজেকে বিবাহিত ও দুই সন্তানের মা বলে স্বীকার করে। একপর্যায়ে সে জানায়, তার স্বামী অত্যন্ত খারাপ লোক। সে তাকে মারধর ও নির্যাতন করে। সে চরম মানসিক কষ্টে আছে। লীনার মা-বাবাও বিষয়টি বুঝতে চাইছে না। তানভীরকে লীনার অনেক ভালো লাগে। সে হ্যান্ডসাম, সুন্দর করে কথা বলে। গিয়াসকে খুন করলে দুই সন্তানসহ লীনা তার হবে। সঙ্গে গিয়াসের মার্কেট, বাড়িসহ সব সম্পত্তিও পাবে। পুলিশকে তানভীর জানায়, ‘সে অনেক ভালো মেয়ে, তাকে আমি অনেক লাভ (ভালোবাসা) করি। সেও আমাকে অনেক লাভ করে।’ ঘটনার তিন মাস আগে তানভীরকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় লীনা। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজীপাড়ার এক মাদ্রাসায় ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর ৫ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে করে তারা। সেখানে তানভীর ও লীনার কয়েক বন্ধু উপস্থিত ছিল।’ বিয়ের পর তারা গিয়াসের বাসাতেই বাসর ঘরও করে। বিয়ের পর লীনা বরাবরই গিয়াসকে মেরে ফেলার জন্য চাপ দিতে থাকে। বিয়ের পর দুজনের একসঙ্গে থাকার বাধা দূর করতে লীনা পরিকল্পনা করে। লীনার পরামর্শে জিসান ও মুক্তর সঙ্গে ৫০ হাজার টাকায় চুক্তি করে তানভীর। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগে থেকেই বাসায় গিয়ে অবস্থান নেয় তিনজন। এ সময় লীনা ফোন করে গিয়াসকে বলে বাসায় মেহমান এসেছে। এরপরের ঘটনা সেই নৃশংস ঘটনা।

গ্রেফতারের পর সবার ধারণা ছিল, এমন পরিকল্পিত হত্যার সঙ্গে জড়িত লীনা, তার প্রেমিক ও সহযোগীদের বিচার হবে। নিহত গিয়াস উদ্দিনের পরিবারও আশা করেছিল, খুনিরা ছাড় পাবে না। কিন্তু না। সেই লীনা, তার প্রেমিক তানভীর, তানভীরের দুই বন্ধু জামিনে বেরিয়ে গেছে। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে, ১৯ অক্টোবরের আগের দিন ১৮ অক্টোবরও তাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রথম দফায় খুনিদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৮ অক্টোবর টার্গেট অনুযায়ী গিয়াসের স্ত্রী লীনা ও প্রেমিক তানভীর আহমেদ সবকিছু প্রস্তুত রাখে। তানভীর তার বন্ধুকেও প্রস্তুত থাকতে পরামর্শ দেয়। সবকিছু ঠিক থাকার পরও শেষপর্যায়ে এসে ওই দিন গিয়াসকে হত্যা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ ওই দিন স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আত্মীয়ের বাসায় হঠাৎ বেড়াতে যান গিয়াস উদ্দিন।

সর্বশেষ খবর