শিরোনাম
বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দখলবাজদের কবলে বিমানবন্দর

সাঈদুর রহমান রিমন

দখলবাজদের কবলে বিমানবন্দর

শাহজালাল বিমানবন্দর সংলগ্ন সড়কের বেহাল দশা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দখল আর বখরাবাজিকবলিত বিমানবন্দর এলাকা ঘিঞ্জি হাটবাজারে পরিণত হয়েছে। বিমানবন্দরের প্রবেশমুখ থেকে হাজী ক্যাম্প, এপিবিএন হেডকোয়ার্টার থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় তিল ধারণেরও ঠাঁই নেই। সেখানকার প্রধান রাস্তা, অলিগলি, বাসস্ট্যান্ড, কার পার্কিং সবকিছুই জবরদখল করে বসানো হয়েছে বাজার। রাস্তা-ফুটপাথের প্রতি ইঞ্চি জায়গা স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানপাটে ঠাসা। রেলস্টেশনের পার্কিং পয়েন্ট এখন কয়েক শ দোকানপাটের জমজমাট মার্কেট। রেললাইনের কোনায় কোনায় ঝুপড়ি বস্তির দোকানপাট। সবজি আর মাছের বাজার বসানোর ফলে স্টেশনের বহির্গমন রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। দুপুর গড়ালেই বিমানবন্দর মোড় ক্রেতা-বিক্রেতা-পথচারীর ভিড়-ভাড়াক্কায় শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। তখন আশকোনা হাজী ক্যাম্প রোড ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনমুখে যানবাহন চলাচল দূরের কথা, হেটে চলাচলও কঠিন। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় এই জঘন্য অবস্থার প্রতিকার করারও যেন কেউ নেই। গত দুই দিন সরেজমিন অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, দৈনিক ‘তোলা’ সাড়ে ৩ লক্ষাধিক টাকার বখরাবাজি সহস্রাধিক দোকানপাটের অবৈধ বাজার জিইয়ে রেখেছে। সেখানে বিমানবন্দর পুলিশবক্সের ইনচার্জ ও রেলওয়ে পুলিশের এক এসআইসহ কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এ টাকার ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একদিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অন্যদিকে রয়েছে দেশের একমাত্র হাজী ক্যাম্প। বিমানবন্দরের প্রবেশমুখ থেকে হাজী ক্যাম্প পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বাজার বসিয়ে রেলওয়ে থানা ও পুলিশবক্সের নামে চলছে চাঁদাবাজির মচ্ছব। চলছে দখল-বেদখলের প্রতিযোগিতা। জানা যায়, রেলওয়ে এলাকায় অবৈধ দোকানপাট থেকে তোলা যাবতীয় চাঁদার বখরা হাতিয়ে নেন আলী আকবর নামে জিআরপি থানার এক সাব-ইন্সপেক্টর। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন কনস্টেবল মোতাহার হোসেন, কামাল, করিম আলী ও সেলিম মিয়া। তারা বিমানবন্দর রেলস্টেশন, পার্কিং পয়েন্ট ও রেললাইন ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা কয়েক শ দোকানপাট থেকে দিনভিত্তিক চাঁদা তুলে থাকেন। দোকানপিছু আলাদা আলাদা চাঁদার রেট ধার্য রয়েছে। সাধারণ হকার্স দোকান দৈনিক ৬০০, বেড়া ও ছাউনিযুক্ত দোকানপ্রতি ৮০০, হোটেল-রেস্তোরাঁ ১০০০ এবং মাছ বিক্রেতাদের একেকটি দোকান প্রতিদিন ১২০০ টাকা। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর আলী আকবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘রেল সীমানায় অবৈধ দোকানপাট নেই বললেই চলে। ফুটপাথ দখল, রাস্তায় বাজার বসানো, চাঁদাবাজির সবকিছুই ঘটে বিমানবন্দর পুলিশবক্সের দায়িত্বভুক্ত এলাকায়।’ এদিকে রেলস্টেশনের বহির্গামী রাস্তা দখল করে মাছ বাজার বসিয়েছে প্রভাবশালী একটি চক্র। তারা একেকটি মাছের দোকানের পজিশন বাবদ এককালীন ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা আদায় করে নিয়েছে। এদিকে স্টেশন পার্কিংসহ ফুটওভার ব্রিজ ঘেঁষে গড়ে তোলা ২ শতাধিক দোকান দেখভাল করে থাকেন মলম পার্টির সরদার আখতার হোসেন। ইদানীং শ্রমিক লীগের নেতা পরিচয়ে ব্যানার-ফেস্টুন টানিয়ে দিয়েই তিনি চাঁদার হার দ্বিগুণ করে দিয়েছেন। তার সহযোগীরা বিমানবন্দরসংলগ্ন পশ্চিম পাশের পাবলিক টয়লেট থেকে এপিবিএন হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত এলাকায় গড়ে তোলা মার্কেটের চাঁদাবাজিও নিজের কব্জায় নিয়েছেন আখতার ও তার সহযোগীরা। সেখানে স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে দেড় শতাধিক দোকান, ওয়ার্কশপ, গ্যারেজসহ বেশ কয়েকটি হোটেল-রেস্তোরাঁ। এসব দোকান থেকে আখতারের সহযোগীরা প্রতিদিন ৮০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। জিআরপির এসআই আলী আকবরের হয়ে ফুটপাথ বাজারে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালিয়ে থাকেন বাবু নামের এক যুবক। ওই এলাকায় সবাই তাকে ‘নাঈমের বাবু’ হিসেবেই চেনেন-জানেন। তারই নেতৃত্বে স্টেশন থেকে বের হওয়ার রাস্তা দখল করে মাছের বাজার ও সবজিহাট বসানোর অভিযোগ রয়েছে। এদিকে হাজী ক্যাম্প থেকে শুরু করে বিমানবন্দর মোড় পর্যন্ত আশকোনা রোডটি এখন পুরোপুরি বাজার। সেখানে ফুটপাথে বসে স্থায়ী দোকানপাট আর রাস্তাজুড়ে থাকে অস্থায়ী হকার্স মেলা। ওই সড়কে গাড়ি নিয়ে চলাচল দূর কথা, ভিড়-ভাড়াক্কায় হাঁটাও দায়। ঝুপড়ি বস্তির দোকান জঞ্জালে আশপাশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ক্ষেত্রেও নানারকম বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমানবন্দর পুলিশবক্সের ইনচার্জ সাব-ইন্সপেক্টর মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে আশকোনা রোডেই ৩ শতাধিক অবৈধ দোকানপাট বসানো হয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে এককালীন ৬০ হাজার এবং প্রতিদিন গড়ে ৪০০ টাকা চাঁদা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

চাঁদার টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে এসআই মোস্তাফিজের সহযোগী লাইনম্যান হিসেবে দায়িত্বে আছেন বাবুর্চি মনির, প্যাটকা বাবলু, ইবরাহিমসহ পাঁচ-ছয় জন। এর বাইরেও বিমানবন্দর থানা পুলিশের নামে চাঁদা তোলেন জনৈক জামাল, তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন খায়রুল। ফুটপাথের চাঁদাবাজরা সবাই লাইনম্যান হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিমানবন্দর থানার নিযুক্ত লাইনম্যান জামালের দৌরাত্ম্য সর্বত্র। তিনি কসাইবাড়ী রেলগেট থেকে শুরু করে আশকোনা রোড হাজী ক্যাম্প পর্যন্ত এলাকায় সব ধরনের ব্যবসায়ী, হকার, ফুটপাথ দোকান থেকে দৈনিক ২০০ টাকা হারে চাঁদা তুলে থাকেন। জামাল ছাড়া বাকি চাঁদাবাজদের এলাকা ও লাইন ভাগ করা আছে। বাবলু ও মনির (বাবুর্চি মনির) বিমানবন্দর বক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসআইর লাইনম্যান হিসেবে বখরাবাজি করলেও রেললাইন ও স্টেশন এলাকায় তাদের কোনো খবরদারিত্ব নেই। অন্যদিকে জিআরপির লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত সেলিম, লাইট বাবু, আক্তার হোসেন ও করিম আলীর চাঁদাবাজির সব দৌরাত্ম্য চলে রেল সীমানার ভিতরে; কিন্তু বাইরের রাস্তা-ফুটপাথ বাজারে তাদের কোনো পাত্তা নেই।

ফুটপাথ বাজারে বেপরোয়া চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে বিমানবন্দর পুলিশবক্সের ইনচার্জ এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুলিশ ফাঁড়িতে জনবলের অভাব থাকায় ফুটপাথ দখলবাজদের বিরুদ্ধে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তা ছাড়া রাজনৈতিক পরিচয়কে সাইনবোর্ড বানিয়ে সংঘবদ্ধ একটি চক্র ফুটপাথ বাজার জিইয়ে রেখে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। তারা ফুটপাথবিরোধী পুলিশি অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করে, আবার তারাই পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলে। ফুটপাথ বাজারের এতসব ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যেও বাড়তি জঞ্জাল হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা।

 দক্ষিণখানজুড়ে চলাচল করা শত শত নিষিদ্ধ অটোর বড় স্ট্যান্ড হয়ে উঠেছে রেলগেট ও হাজী ক্যাম্পের গেট এলাকা। দিনভর এসব অটোরিকশার আনাগোনা, যাত্রী ওঠানো-নামানো আর সিরিয়াল ধরানোর ভেলকিতে আশকোনা রাস্তাজুড়েই লেগে থাকে ভয়াবহ যানজট। সেখানে দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদের স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরা সেই যানজট নিরসনে গলদঘর্ম হয়ে পড়েন। কিন্তু এই যানজটের ধকলে বিমানবন্দর মোড় এলাকা অচল হয়ে পড়লেও ট্রাফিক সার্জেন্ট ও কনস্টেবলরা ভুলেও সেই জট ছাড়াতে এগিয়ে যান না।

তারা নিষিদ্ধ অটো চলাচল বাবদ দৈনিক ১০ হাজার টাকা চাঁদা আদায়ের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেন বল অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানান, বিমানবন্দর ছাড়াও আবদুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন ব্যানারে মিলন, মোল্লা, সোহেল, রবি, জাহিদ, জাহাঙ্গীর ও রতন গ্রুপ ফুটপাথ বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। চাঁদা বাবদ তারাই হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

সর্বশেষ খবর