বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৮৯

দেহরক্ষীই যখন ঘাতক

মির্জা মেহেদী তমাল

দেহরক্ষীই যখন ঘাতক

বেলা সাড়ে ১১টা। রাজধানীর ব্যস্ততম বিপণিবিতান ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের অর্কিড প্লাজা। দোতলার শীতল হেয়ার ড্রেসার থেকে বেরিয়ে আসে দুই যুবক। তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই চারদিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলি। তিন-চারজন অস্ত্রধারীর নিশানায় থাকা যুবকটি হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন সিঁড়ির ওপর। রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। লোকজনের ছোটাছুটি। দোকানের শার্টার নেমে যাচ্ছে। কিন্তু অস্ত্রধারীদের গুলি চালানো বন্ধ হচ্ছে না। এরপর মার্কেটের সামনে পার্ক করে রাখা একটি মাইক্রোবাস টার্গেট করে চালাল আরও কয়েক রাউন্ড গুলি। মাত্র দেড় মিনিটেই তাদের মিশন শেষ করে অন্য একটি গাড়িতে চড়ে লাপাত্তা। সিঁড়ির ওপর পড়ে তখনো কাতরাচ্ছিলেন যুবকটি। একবার বাম হাত শূন্যে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। গলা থেকে শুধু ‘গোঁ গোঁ’ শব্দ বেরিয়ে আসছিল। ১০ মিনিট পড়ে থাকার পর নেওয়া হলো হাসপাতালে। চিকিৎসকরা বললেন, সব শেষ। বেশ কিছু সময় আগেই তার মৃত্যু ঘটেছে। অস্ত্রধারীদের নিশানায় থাকা ওই যুবকটির নাম নিউটন। পুরো নাম ছায়েদুর রহমান নিউটন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও ঢাকা সিটি করপোরেশন ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন তিনি। ২০০২ সালের ১০ মে অস্ত্রধারীরা গুলি করে তাকে হত্যা করে। ২২টি তাজা বুলেটে তার পুরো শরীর সেদিন ঝাঁজরা হয়েছিল। সরকার সমর্থিত প্রবল ক্ষমতাধর একজন ওয়ার্ড কমিশনার এভাবে শত শত লোকের সামনে খুন হওয়ায় সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। সদ্য প্রয়াত বিএনপির সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর ভগ্নিপতি ছিলেন নিউটন। নিউটনের মৃত্যুর পর ৮ নম্বর ওয়ার্ডে তার স্ত্রী কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিউটনের গাড়িচালক মিজান ও দেহরক্ষী ইসমাইলের বিশ্বাসঘাতকতায় সেদিন নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে নিউটনকে। নিউটনের গাড়িচালকই কিলার গ্রুপকে নিউটনের অবস্থান জানায়। চালকের কাছ থেকে তথ্য নিয়েই কিলার গ্রুপের সদস্যরা আগে থেকে মার্কেটের নিচে ওতপেতে ছিল। ওই ঘটনায় অবশ্য চালকও সামান্য আহত হন। তবে নিউটনের দেহরক্ষীও সেদিন প্রাণে বেঁচে যান রহস্যজনকভাবে। নিউটন খুনের ঘটনাটি নানা কারণে আলোচিত হয়ে ওঠে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। তারা নিজেরাই এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত, কালা জাহাঙ্গীরসহ আরও বেশ কয়েকজনের উপস্থিতি তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এ ঘটনায় নিহত নিউটনের মা রাবেয়া বেগম ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে ২০০৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কালা জাহাঙ্গীর, কিলার আব্বাস, শাহাদাত, ব্যাঙ্গা বাবুসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়। ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল নিউটন হত্যা মামলায় ২০০৬ সালের ২৪ মে এক রায়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর, মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, মিরপুর বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌফিক আলম পিয়াল, খোরশেদ আলম, সাদেকুল ইসলাম সাগর, কিলার আব্বাস, মনির হোসেন কিরণ, ছাত্রদল কর্মী ইব্রাহিম খলিল, জাকির হোসেন ও নিউটনের দেহরক্ষী কাজী ইসমাইলকে ফাঁসির আদেশ দেয়। শওকত হোসেন, নাজমুল হাসান ওরফে ব্যাঙ্গা বাবু, মো. কামাল হোসেন, মো. আইয়ুব, রাসেল ওরফে ঝন্টু রাসেল ও মো. রুবেল হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১০ জনকে ফাঁসি ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেয়। হাই কোর্টে পরে আপিল করা হয়। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১০ আসামির মধ্যে কিলার আব্বাসসহ তিনজনকে খালাস দেয় হাই কোর্ট। শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর, শাহাদাত হোসেনসহ অন্য সাতজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছয় আসামির মধ্যে তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনজনের সাজা বহাল রাখা হয়। মামলার নথি থেকে জানা যায়, সেদিন ছিল নিউটনের ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। ধানমন্ডির একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঘটনার দিন সকাল ১০টায় মিরপুরের বাসা থেকে বের হন নিউটন। সঙ্গে ছিল তার দেহরক্ষী ইসমাইল। গাড়িচালক মিজান তাদের মাইক্রোবাস চালাচ্ছিলেন। তারা অর্কিড প্লাজার সামনে এসে মাইক্রোবাস থেকে নেমে যান। দোতলার শীতল হেয়ার ড্রেসারে ঢুকে পড়েন চুলে কলপ করার জন্য। বাইরে মাইক্রোবাস নিয়ে বসে থাকেন চালক মিজান। সাড়ে ১১টার দিকে দুজনই সেলুন থেকে বের হন। নিচে নামতে গিয়েই অস্ত্রধারীদের হামলার শিকার হন নিউটন। পেছন থেকে হাওয়া হয়ে যায় দেহরক্ষী ইসমাইল। নিউটন রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়লে অস্ত্রধারীরা মাইক্রোবাস লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। এতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে যায়। একটি গুলির আঁচড় লাগে চালক মিজানের। পুলিশ জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর, শাহাদাত, কিলার আব্বাস, কচিসহ মিরপুরের চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিউটনের বিরোধ চলে আসছিল। সদ্য নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার নিউটনের কারণে তারা চাঁদাবাজি বা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাতে পারছিল না। যে কারণে তাকে হত্যার নীলনকশা করে। আর এ হত্যাকাণ্ডে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নিজেরাই উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিউটনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। চিকিৎসকরা তার শরীরে ২২টি গুলির অস্তিত্ব পান। সাতটি গুলি তার শরীর থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয় বিএনপি ও ছাত্রদলের শত শত নেতা-কর্মী সেখানে হাজির হন। ট্রলিতে রাখা লাশ ধরে কান্নার রোল পড়ে সেখানে। তিন মাসের শিশু বুকে নিয়ে নিউটনের স্ত্রী মিষ্টি তখন আহাজারি করছিলেন। নিউটনের বাবা দুই হাত তুলে বলছিলেন, আল্লাহ তোমার জিনিস তুমি নিয়ে গেছ। খুনিদের বিচার কর। গোয়েন্দারা তদন্ত করে জানতে পারে, নিউটনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যিনি ছায়ার মতো ছিলেন, যার দায়িত্ব ছিল নিউটনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেই দেহরক্ষী ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তার দেওয়া তথ্যে ঘাতকের দল ওই মার্কেটের নিচে অবস্থান নিয়ে থাকে। নিউটনের প্রতিটা স্টেপ দেহরক্ষী জানিয়ে দেয় ঘাতকের কাছে। যে কারণে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি নিউটন। সেই সময়ের প্রবল ক্ষমতাধর হয়েও নিউটনকে খুনের শিকার হতে হয় কোনোরকম বাধা ছাড়াই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর