বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কদর বেড়েছে ভোট কারবারিদের

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর থেকে

কদর বেড়েছে ভোট কারবারিদের

আনুষ্ঠানিক প্রচারণার বাকি আর মাত্র চার দিন। এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গেছে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা।

৪ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। প্রতীক পাওয়ার পর প্রচার-প্রচারণায় জমে উঠবে নির্বাচনী মাঠ। প্রস্তুত আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলের মেয়র প্রার্থীরা। বসে নেই কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। এখনই দম ফেলার সময় নেই প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকে প্রার্থীরা ঘরোয়া বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে প্রার্থীরা প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপনসহ ওয়ার্ড ভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠনের কাজটিও সেরে ফেলেছেন। এখন ভোট কারবারিদের কাছে টানার কাজ করছেন প্রার্থীরা। এদিকে ঋণ থাকার কারণে বিএনপির মেয়র প্রার্থী কাওসার জামান বাবলার বৈধ মনোনয়নের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সোনালী ব্যাংক। সোনালী ব্যাংক ঢাকার বৈদেশিক বাণিজ্যিক করপোরেট শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) গতকাল নির্বাচন কমিশনের গঠন করা রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ সংক্রান্ত কমিটির প্রধান রংপুরের বিভাগীয় কমিশনারের কাছে এই আপিল করেন। আপিলে বলা হয় মেসার্স এজাক্স জুট মিলের নামে মেয়র প্রার্থী কাওসার জামান বাবলাসহ পাঁচ পরিচালক যৌথ নামে ৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। যা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। তবে ২৬ নভেম্বর যাচাই-বাছাইয়ে কাওসার জামান বাবলার মনোনয়ন বৈধ করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে কাওসার জামান বাবলা বলেন, যৌথ নামে ৪২ কোটি টাকা কোম্পানি ঋণ আছে। কিছু টাকা পরিশোধও করা হয়েছে। যৌথনামে থাকা ঋণ একক ব্যক্তির ওপর বর্তায় না। আশা করি শুনানিতে ব্যাংকের আপিল টিকবে না। এ ছাড়া যাচাই-বাছাইয়ে বাতিল হওয়া ৬ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে তিনজন তাদের মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

এরা হলেন— স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম আবদুর রউফ মানিক, মেহেদী হাসান বনি ও সুইটি আনজুম। অপরদিকে মনোনয়ন বাতিল হওয়া ১২ জন সংরক্ষিত নারী ও সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত আপিল করেছেন পাঁচজন। আজ আপিলের শেষ দিন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার আপিলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এলাকা ভিত্তিক ভোটার নিয়ন্ত্রণ ও ভোট সংগ্রহের কাজ যারা করেন তারাই ভোট কারবারি হিসেবে পরিচিত। তারা নিজ নিজ এলাকায় প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই ভোট কারবারিদের মাধ্যমেই প্রার্থীরা এলাকাভিত্তিক ভোটারদের নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভোটের পাল্লা ভারী করেন। নির্বাচনে ভোটাররা সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের নিয়ে প্রচারণা চালানোটা পছন্দ করেন না। সে কারণেই প্রার্থীদের কাছে ভোট কারবারিদের কদর বেড়ে যায়। কোন প্রার্থী কেমন মূল্যায়ন করবেন, কেমন সুযোগ সুবিধা দেবেন এনিয়ে প্রার্থীদের সঙ্গে ভোট কারবারিদের চলছে দর কষাকষি। যে প্রার্থী বেশি সুযোগ-সুবিধা দেবেন ভোট কারবারিরা তাদের পক্ষেই কাজ করবেন।

একাধিক ভোট কারবারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচনে অনেক এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমাদের কথার বাইরে ভোটাররা কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। যে কারণে নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা আমাদের পাশে পেতে চান। ভোট নিশ্চিত করার জন্য ভোটারদের অনেক সময় আর্থিকসহ নানান সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। ভোট গ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে আমরাও বেশকিছু আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকি।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পৌনে চার লাখ ভোটারের কাছে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই সংশ্লিষ্ট এলাকার সুশীল সমাজ, সম্মানিত ব্যক্তি ও দলের দায়িত্বশীল নেতাদের মাধ্যমেই ভোট চাওয়ার কাজটি করা হয়। কোনো কোনো এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এ কাজটি করে থাকেন।

জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, সন্ত্রাসী-মাস্তান দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম চালানোর দিন আর নেই। ভোটের পাল্লা ভারী করার কৌশল হিসেবেই স্থানীয় প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্বাচনে কাজে লাগানো হয়। এসব কাজে কিছু অর্থও খরচ হয়। 

বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা বলেন, নির্বাচনে স্থানীয় গণ্যমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই ভোটের পাল্লা ভারী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ কারণেই ওয়ার্ড ভিত্তিক নির্বাচনী পরিচালনা কমিটিগুলোতে তাদের মূল দায়িত্বে রাখা হয়েছে।

২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী হাফিজ আহমেদ ছুট্টু বলেন, ভোট কারবারিদের কাছে টানা ছাড়া নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। গত নির্বাচনে এই ভোট কারবারিরাই আমাকে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।

নগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের শনিবাড়ি বস্তির আবদুল জব্বার, খাদেমুল ইসলাম ও তৈয়বুর রহমানসহ একাধিক ভোটার বলেন, ‘ভোট আইলে এলাকার তিনজন দেওয়ানি বস্তির ভোটারদের নিয়া মিটিং করেন। তারা যামাক (যাকে) ভোট দিতে কন, হামরা তাকে ভোট দেই। ওই দেওয়ানিরা বস্তিবাসীর সুখে-দুখে পাশে থাকেন।’  

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রংপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মলয় কিশোর ভট্টাচার্য বলেন, ভোট কারবারিদের মাধ্যমেই কালো টাকা ছড়াছড়ি হয়ে থাকে। প্রার্থীর পক্ষে ভোট আদায়ে ভোট কারবারিরা বিভিন্ন কৌশলে ভোটারদের মন জয় করে থাকেন। যে কারণে নির্বাচন এলেই প্রার্থীদের কাছে ভোট কারবারিদের কদর বেড়ে যায়।

সর্বশেষ খবর