বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

এখনো স্বপ্ন দেখেন রমা চৌধুরী

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

এখনো স্বপ্ন দেখেন রমা চৌধুরী

জীবনযুদ্ধে জয়ী এক নারীর নাম রমা চৌধুরী। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘ চলার পথে প্রতিটি বাঁকে যুদ্ধ করেছেন কিছু না দেওয়া এই সমাজের বিরুদ্ধে, পারিপার্শ্বিকতার বিরুদ্ধে। হার না মানা মনটায় এখনো উদ্যম থাকলেও শেষ বয়সে এসে তার শরীরে বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিকস, গলব্লাডারে পাথর, অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার, হৃদরোগ, অ্যাজমাসহ নানান জটিল রোগ। বন্দরনগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুপথযাত্রী এই বীরাঙ্গনার তবুও স্বপ্নের শেষ নেই। এই নারীর স্বপ্ন— তিনি তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করে যেতে চান। কিন্তু তার এ স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থসংকট। একদিকে যেমন অর্থের অভাবে হচ্ছে না তার উন্নত চিকিৎসা, অন্যদিকে পুনরায় চালু করতে পারছেন না নিজ হাতে গড়া অনাথ আশ্রমটি। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করা এই নারী সব ধর্মের অনাথ শিশুদের জন্য একটি আশ্রম খোলার উদ্যাগ নেন বেশ কয়েক বছর আগে। বই বিক্রির টাকা দিয়ে নিজ অর্থায়নে ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’ নামে গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি অনাথ আশ্রম। কিন্তু অর্থের অভাবে থমকে যায় তার সেই স্বপ্নের অনাথালয়ের কার্যক্রম। এখন বন্ধ রয়েছে অনাথ আশ্রমটি। এ আশ্রম নিয়ে নিজের স্বপ্ন নিয়ে রমা চৌধুরী বলেন, ‘দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে অনাথ আশ্রম খোলার ইচ্ছা ছিল। সেই আশ্রমে বসবাস করবে সব ধর্মের অনাথরা। দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয় খুললাম কিন্তু চালাতে পারিনি। এখন নিজেরই চিকিৎসার খরচ চালাতে পারি না। সেখানে আশ্রম চালাব কী করে? তবে যদি সুস্থ হয়ে উঠি, যদি সুযোগ আসে আবার চালু করব অনাথ আশ্রমটি।’ সুলেখিকা রমা চৌধুরী স্বাধীন দেশে অর্থ ও চিকিৎসার অভাবে মরতে চান না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে রমা বলেন, ‘এই জীবনে অনেক কিছুই লেখার বাকি রয়েছে। আমি আবার কলম ধরতে চাই। নারী জাগরণের জন্য ভূমিকা রাখতে চাই।’ আক্ষেপ করে বলেন, ‘টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছি না। সরকারের উচ্চপদস্থ কেউ আমার খোঁজখবর নেননি। এমনকি তাদের কেউ ফোন পর্যন্ত করেননি। উল্টো চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অপদস্থ হয়েছি।’ রমা চৌধুরীর প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও তার বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন বলেন, ‘অর্থের অভাবে তার চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। তার চিকিৎসার জন্য সবার এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করছি।’

১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রমা চৌধুরী। তিন বছর বয়সে হারান বাবাকে। মা মতিময়ী চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় শত বাধা পেরিয়ে চালিয়ে যান পড়াশোনা। এইচএসসি পাস করার পর শিক্ষকতাকে বেছে নেন রমা। বোয়ালখালীর বেঙ্গুরা কে বি কে আর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেন। তিনিই ঢাবি থেকে স্নাতকোত্তর করা চট্টগ্রামের প্রথম কয়েকজন নারীর মধ্যে অন্যতম। ওই বছরই কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। ’৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে নতুন যুদ্ধে নেমে পড়েন রমা। এলাকার রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী রমা চৌধুরীর বাড়িতে হানা দেয়। ধর্ষণের পর তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় হানাদাররা। এ ঘটনার ক্ষত না শুকাতেই দুই বছর পর রমা চৌধুরীর দুই সন্তান সাগর (৫) ও টগর (৩) মারা যায়। স্ত্রীর সম্ভ্রম ও প্রিয় দুই সন্তান হারানোর ঘটনায় শোকে-দুঃখে দেশান্তরি হন স্বামী। তবু দমে যাননি রমা চৌধুরী। চালিয়ে যান জীবনযুদ্ধ। শিক্ষকতা জীবনে ১২টির বেশি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এত বেশি বিদ্যালয় পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনগ্রসর স্কুলগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করাই আমার চিন্তা ছিল। তাই অনগ্রসর স্কুলগুলোর দায়িত্ব নিতাম। যখন স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ একটা পর্যায়ে আসত তখন ফের নতুন করে আরেকটা অনগ্রসর স্কুলের দায়িত্ব নিতাম। আমি যেসব স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি, সবই আজ ভালো অবস্থানে।’

শিক্ষকতার পাশাপাশি নারী জাগরণে কাজ করেছেন রমা চৌধুরী। সাহিত্যের শাখায়ও বিচরণ করেছেন সমানতালে। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে রমা চৌধুরীর লেখা ১৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— নজরুল প্রতিভার সন্ধানে, স্বর্গে আমি যাব না, চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যে জীবনদর্শন, শহীদের জিজ্ঞাসা, নীল বেদনার খাম, ’৭১-এর জননী, এক হাজার এক দিন যাপনের পদ্য, সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভাববৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ এবং নির্বাচিত প্রবন্ধ ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে আরও কয়েকটি বই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লেখালেখি নিয়ে অতৃপ্তিই থেকে গেছে রমা চৌধুরীর। হাসপাতালের বেডে শুয়ে এখনো ভাবেন আবার কবে কলম ধরবেন। অসুস্থতার জন্য লিখতে না পারার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে বলেন, ‘এখনো অনেক কিছুই লেখার বাকি। তাই আমি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরতে চাই। আবার লেখালেখি শুরু করতে চাই। অনাথদের জন্য আমার আশ্রমটি আবার চালু করতে চাই।’

নগরীর জামাল খান মোমিন রোডে লুসাই ভবনের একটি কক্ষে রমা চৌধুরী বসবাস করছেন ১৭ বছর ধরে। সুখ-দুঃখের সাথী তার সেই ঘর। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে এই বীরাঙ্গনা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওই সাক্ষাৎ ঘটনাকে জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত বলে মনে করেন রমা চৌধুরী। তিনি জানান, ‘ওই সাক্ষাতের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, “আপনি আমার বড় বোন”। সেদিন ছোট বোনের সঙ্গে ওই সাক্ষাৎই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। তাঁর কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। শুধু বড় বোন হিসেবে দোয়া করি, আমার ছোট বোন যেন দীর্ঘজীবী হন।’

সর্বশেষ খবর