বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পিতা-পুত্রের বেপরোয়া কাণ্ডে দিরাইয়ে আতঙ্ক

মাসুম হেলাল, সুনামগঞ্জ

প্রয়াত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দিরাই এখন পৌর মেয়র মোশাররফ মিয়া ও তার ছেলে উজ্জ্বল মিয়ার বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে আতঙ্কের জনপদের নাম। খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জলমহাল দখল, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, সরকারি অফিস-আদালত নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব ধরনের বেআইনি কাজ-কারবারের সঙ্গে যুক্ত বেপরোয়া এই ‘বাপ-বেটা’র নাম।

মোশাররফ মিয়া দিরাই পৌরসভার মেয়রের মতো একটি দায়িত্বশীল পদে থাকলেও জলমহাল দখল নিয়ে গত বছরের আলোচিত ট্রিপল মার্ডার মামলার প্রধান আসামি। ওই মামলার অন্যতম আসামি তার ছেলে উজ্জ্বল মিয়াসহ দুই ছেলে। দীর্ঘ দুই বছর ধরে পলাতক আসামির খাতায় মেয়রের নাম থাকলেও তিনি ঘুরে বেড়ান থানা-পুলিশের নাকের ডগায়, অংশ নেন নিয়মিত পৌরসভার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে নিজের ক্ষমতার জানান দেন এলাকায়।

জানা যায়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবদ্দশায় তার কাছের মানুষ ছিলেন মেয়র মোশাররফ। কিন্তু প্রবীণ এই পার্লামেন্টারিয়ানের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে দিরাইয়ের রাজনীতি আর অর্থনৈতিক বিষয়-আশয়ে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। সুরঞ্জিতের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মোশাররফ মিয়াকে বাগে আনতে ব্যর্থ হন। তার দাপটের কাছে সুরঞ্জিতপত্নী অনেকটা অসহায় বলে এলাকায় চাউর আছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যের এমন দুর্বলতার সুযোগে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মোশাররফ।     বর্তমানে মেয়র মোশাররফ মিয়াই দিরাইয়ে শেষ কথা। ভুক্তভোগীরা জানান, পুলিশ ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ, রাস্তাঘাটের বরাদ্দ, উন্নয়ন থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক এখন মেয়র মোশাররফ। টিআর, কাবিখা, কাবিটা, কর্মসৃজন, ভিজিএফ, ভিজিডি, বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ইত্যাদি সরকারি বরাদ্দের পুরো উপজেলার অলিখিত নিয়ন্ত্রক তিনি। তার সম্মতিতেই বিলি-বণ্টন হয় এসব। বখরা পান ঘরে বসে। দুই বছর আগে মেয়র মোশাররফ মিয়ার বিরুদ্ধে সরকারি রিলিফের টিন দিয়ে বাড়িতে বাংলো বানানোর অভিযোগ আনেন উপজেলা যুবলীগের এক নেতা। পরে তড়িঘড়ি রঙ করে টিনের সরকারি সিল মুছে ফেলা হয়। গত বছর ১৬ জানুয়ারি উপজেলার জারলিয়া জলমহাল দখল করতে গিয়ে নিরীহ তিন জেলেকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। আলোচিত এ ঘটনার প্রধান আসামি মেয়র মোশাররফ ও তার দুই ছেলে। এ ঘটনায় করা মামলায় মোশাররফ মিয়া দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের খাতায় পলাতক আসামি। তা সত্ত্বেও ক্ষমতার দাপটে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুলিশের নাকের ডগায়। আলোচিত এই জলমহালে এখন রাজত্ব করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না তিনি, অধিক মাছ আহরণের লোভে বন্ধ করে দিয়েছেন হাওরের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র রাস্তাটি। এতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় হাওরের কয়েক হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে বেআইনি কর্মকাণ্ডে বাবার ক্ষমতার পরিপূরক হয়ে উঠেছেন মোশাররফপুত্র উজ্জ্বল মিয়া। বাবার ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করতে নিজের নামে সৃষ্টি উজ্জ্বল বাহিনী এখন দিরাইয়ে আতঙ্কের অপর নাম। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, গুদামে খাদ্যশস্য ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত এই উজ্জ্বল বাহিনী। জানা যায়, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে দিরাই খাদ্যগুদামের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক মোশাররফপুত্র উজ্জ্বল। ধান-চাল সংগ্রহের মৌসুমে তাকে বখরা না দিয়ে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে পারেন না সাধারণ কোনো কৃষক। সরকারি কাবিখার বরাদ্দও বাজারমূল্যের চেয়ে কমে তার কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন উপকারভোগীরা। এদিকে রবিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ট্রিপল মার্ডার মামলার আসামি থাকার পরও মেয়রপুত্র উজ্জ্বল মিয়া তার বাহিনী নিয়ে উপজেলা সদরের সেন মার্কেটের সামনে যুক্তরাজ্য প্রবাসী জনৈক জাবেদ সরদারের কাছ থেকে টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালান। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা উজ্জ্বল বাহিনীকে প্রতিরোধ করলে তারা পালিয়ে যায়। এর এক ঘণ্টা পর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা চালায় উজ্জ্বল বাহিনী। ঘণ্টাব্যাপী তাদের চালানো তাণ্ডবলীলায় গুরুতর আহত হন লন্ডন-প্রবাসী জাবেদ সরদার, সাংবাদিক ইমরান হুসাইনসহ অন্তত ১০ জন। আহত সাংবাদিক ইমরানকে দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। উপজেলা যুবলীগ নেতা মারফত মিয়া জানান, এই অপরাধীরাই দিরাইয়ে নানা ধরনের অপরাধ করে চলেছে। ট্রিপল মার্ডার, কৃষক নির্যাতন, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসাসহ অনেক অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে থাকলেও পুলিশের সামনে এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গরিব-দুখির সহায়তা থেকে শুরু করে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থের একটা বড় অংশে ভাগ বসিয়ে যাচ্ছেন মোশাররফ মিয়া ও তার ছেলে উজ্জ্বল। খুনোখুনি হোক, কিংবা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিবাদ—সব ক্ষেত্রেই বিচারপ্রার্থীর এজাহার থানায় এফআইআর হয় না মোশাররফ সিন্ডিকেটের গ্রিন সিগনাল না থাকলে। দিরাই উপজেলা যুবলীগ নেতা একারার হোসেন বলেন, ‘আমি সব সময় মোশাররফ সিন্ডিকেটের অপকর্মের প্রতিবাদ করতাম। আমার বিরুদ্ধে জনৈক সুবল দাসকে দিয়ে মারধরের একটি মিথ্যা মামলা থানায় করায় মোশাররফ সিন্ডিকেট। তদন্ত প্রভাবিত করে আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়। পরে মামলার বাদী (জিআর ১৭৭/১৮) আদালতে এসে এ ঘটনা মিথ্যা বলে হলফনামা প্রদান করেন।’ জানা যায়, গত বছর হাওরের ফসলডুবির পর পৌর মেয়র মোশাররফ মিয়া কর্তৃক গরিব কৃষকদের মধ্যে ভিজিএফের চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ আনায় উজ্জ্বল বাহিনীর হাতে গুরুতর আহত হন স্থানীয় কৃষক ফয়েজ উদ্দিন। প্রতিবাদী এ কৃষককে ধরে নিয়ে গিয়ে পা ভেঙে দেন মেয়রপুত্র উজ্জ্বল ও তার সহযোগীরা। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হলেও এখনো খুঁড়িয়ে হাঁটেন তিনি। কৃষক ফয়েজ বলেন, ‘মেয়রপুত্র উজ্জ্বলের বিরুদ্ধে থানায়  মামলা করেও কোনো বিচার পাইনি। এ কারণেই তারা একের পর এক অপরাধ করে চলেছে।’ দিরাই পৌরসভার মেয়র মোশাররফ মিয়া নিজের ও ছেলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের গ্রুপিংয়ের কারণে আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। একটি পক্ষ চায় এখানে আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাক।’ প্রতিপক্ষের এমন ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা দিরাইয়ের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না বলে দাবি করেন তিনি। রবিবারে রাতে দিরাই উপজেলা সদরে সংঘটিত ঘটনায় তার ছেলে জড়িত নন দাবি করে মেয়র মোশাররফ বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে হাতাহাতির হয়েছিল, আমার মধ্যস্থতায় আহত সাংবাদিক ও প্রবাসীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জড়িতরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একটি পক্ষ এখানে ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে।’ দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘খবর পেয়ে তাত্ক্ষণিক পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এ ব্যাপারে থানায় কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এদিকে সাংবাদিক ইমরানের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন দিরাই প্রেস ক্লাবের নেতারা। ঘটনার প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে গতকাল দুপুরে উপজেলা সদরে সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর