সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

শেয়ারবাজারে ফের ভয়াবহ ধস

আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান, বাজার স্থিতিশীলতায় চার প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রায় তিন বছর পর আবারও ভয়াবহ ধস নেমেছে ঢাকা শেয়ার বাজারের প্রধান সূচকে। এ ঘটনায় ডিএসই কর্তৃপক্ষ শীর্ষ ব্রোকারেজ মালিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে। পরে সংবাদ সম্মেলন করে কাউকে গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে বিনিয়োগকারীরা গতকাল ব্যাপকহারে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকরা এটাকে নিছক গুজব আখ্যা দিয়েছেন। এদিকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চার দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে ডিএসই। গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিনের লেনদেনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ডিএসইএক্স সূচক ১৩৩ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ২১ শতাংশ কমে ৫ হাজার ৮৮৮ পয়েন্টে নেমে গেছে। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিলের পর ডিএসইতে এটিই সর্বোচ্চ ধস। সে বছর ডিএসইএক্সের এই সূচক ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে ৪ হাজার ৯৪ পয়েন্টে নেমেছিল। গতকাল ডিএসইর প্রধান সূচকের দ্রুত পতনের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ডিএসইএক্স কর্তৃপক্ষ শীর্ষ ব্রোকারেজ মালিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে।

এ সময় বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। গতকাল লেনদেন শেষে মতিঝিলে ডিএসই বোর্ড রুমে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ ধরনের সূচক পতনের ঘটনায় বাজার সংশোধন হয়ে থাকে। তবে গতকালের পতনের ঘটনা নিছক গুজবের কারণে ঘটেছে বলে জানিয়েছে ডিএসই। এজন্য কাউকে গুজবে কান না দিতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে চারটি প্রস্তাব দেয় বিএসইসি। চার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে কস্ট প্রাইসে এক্সপোজার বিবেচনা, বন্ডে বিনিয়োগ এক্সপোজারের বাইরে দেখা, হাউসগুলোর নতুন শাখা খোলার অনুমতি, লেনদেন ডাটার গোপনীয়তা রক্ষা করা। চার প্রস্তাবের সঙ্গে ভয়াবহ দরপতনে রাজনৈতিক গুজব ব্যাংকের এডিআর কমানো ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অসহযোগিতাকে দায়ী করেন তারা। বৈঠকে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ডিএসই ব্রোকারর্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) এবং ডিএসই শীর্ষ ৩০ ্ব্রোকারের মালিকরা এতে অংশ নেন।

বৈঠক শেষে ডিবিএ সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, আজকের (গতকাল) বৈঠকে শীর্ষ ৩০ ব্রোকারেজ প্রতিনিধিদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে বলা যায়, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিছক গুজবের কারণে হয়েছে। পাশাপাশি বাজার খারাপ হলে প্রাতিষ্ঠানিক বড় বিনিয়োগকারীদের থেকে যে সাপোর্ট আমরা পেতাম, সেটা এবার পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, অতীতে বহু রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে অনেক গুজবের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এবারের ঘটনা একটু বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও বলেন, বাজারে সাপোর্ট দিতে আমরা আইসিবিকে বরাবরই শক্তিশালী অবস্থান নিতে দেখেছি। তবে খোদ আইসিবিকেই যদি দুর্বল করে রাখা হয়, তাতে সাপোর্ট লেবেলও দুর্বল হয়ে যাবে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে বাজার ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি।

এ সময় বিএমবিএ সভাপতি মুহাম্মদ নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমরা শীর্ষ ব্রোকারেজ প্রতিনিধিদের বক্তব্যের ভিত্তিতে কিছু প্রস্তাব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে দিতে চাই। এর মধ্যে কস্ট প্রাইসে এক্সপোজার বিবেচনা, বন্ডে বিনিয়োগ এক্সপোজারের বাইরে রাখা, হাউসগুলোর নতুন শাখা খোলার অনুমতি, লেনদেন ডাটার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এসব বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন হলে দীর্ঘ মেয়াদ পুঁজিবাজার ভালো থাকবে।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিন দিনের লেনদেন শুরু হয় দরপতন দিয়ে। এক পর্যায়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইক্স ১৪০ পয়েন্টের বেশি কমে যায়। এদিন শুরু থেকেই সূচক নামতে শুরু করে। চার ঘণ্টার লেনদেনের প্রায় পুরো সময় ধরে সূচকের নিম্নগতি ছিল। শেষ পর্যন্ত ডিএসইএক্স ১৩৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৮৮৮ পয়েন্টে নেমেছে। গত ছয় কার্যদিবসের মধ্যে পাঁচ দিনই ডিএসইএক্স কমেছে প্রায় ৩২৭ পয়েন্টের বেশি। গত একমাসে সূচক কমেছে ৩৮০ পয়েন্ট। এর আগের ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল ডিএসইএক্সের সর্বোচ্চ পতন হয়। সেদিন এই সূচক ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে ৪ হাজার ৯৪ পয়েন্টে নামে। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪ হাজার ৫৫ দশমিক ৯০ পয়েন্ট ডিএসইএক্স সূচক চালু হয়। ওই বছরেরই ২১ জুলাই এর আগের সর্বোচ্চ দরপতন হয়। সেদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ কমে ৪ হাজার ৯০ পয়েন্টে ঠেকেছিল।  তবে সূচকের ভয়াবহ পতনের দিনেও ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। এদিন ডিএসইতে ৩৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যা আগের দিন থেকে প্রায় ৩৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি। বৃহস্পতিবার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ৩২৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নিয়েছে ৩৩৬টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে দর বেড়েছে ২৩টির, কমেছে ৩০২টির। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১১টি কোম্পানির শেয়ার দর।

এদিকে গতকাল চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) সার্বিক সূচকও কমেছে ৪০৮ পয়েন্ট। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রায় ও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রণীত মুদ্রানীতিতে অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) কমানোর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা অসহযোগিতা করছে। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে। এই আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। গতকাল চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) ১৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৪০৮ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৮ হাজার ২১৫ পয়েন্টে। দর বেড়েছে ১৩টির, কমেছে ১৯৬টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১২টির শেয়ার দর।  এ বিষয়ে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক আমানত-ঋণের অনুপাত (এডিআর) কমানো ও মুদ্রানীতি ঘোষণা নিয়ে জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয় শেয়ারবাজারে।

 এখন এডিআর কমানোর ফলে বাজারে গুজব ছড়িয়েছে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমে যাবে। এটা এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার রায়ের তারিখ ঠিক হওয়ায় রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এই অনিশ্চয়তার নেতিবাচক প্রভাবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু না থাকলেও গুজব ছড়িয়ে একটি মহল সুবিধা নিতে পারে। এজন্য সবার সতর্ক থাকা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর