বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপির সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে ভোর থেকেই রাজধানীতে প্রস্তুত ছিল আওয়ামী লীগ। রাজধানীর প্রবেশপথগুলোসহ প্রায় ২০০টি পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে গুলিস্তান পার্টি অফিসের সামনে অবস্থান নিতে থাকেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা-কর্মীরা। বেলা ১০টার দিকে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর সমাগম ঘটে সেখানে। থেমে থেমে নেতা-কর্মীরা চোরের মা খালেদা, তাড়াতাড়ি জেলে যা,’ ‘ডাক দিয়েছে সম্রাট ভাই ঘরে থাকার সময় নাই’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত রাখেন। তাদের গায়ে ছিল সবুজ টিশার্ট ও মাথায় সবুজ ক্যাপ। সোয়া ১০টার দিকে যুবলীগ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা এসে নেতা-কর্মীদের উৎসাহ জোগান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আসেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত ও সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদসহ মহানগরের নেতা-কর্মীরা। একই সঙ্গে আসেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার, কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনসহ বহুসংখ্যক নেতা-কর্মী। এ সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও বক্তৃতাও করেন নেতারা। ২টা ২৯ মিনিটে রায় ঘোষণার পরে আনন্দ মিছিল করেন নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, হকার্স লীগ, তাঁতী লীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিছিল সহকারে জড়ো হন ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। গুলিস্তানের আশপাশের এলাকাতেও নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি ছিল। এদিকে রায় ঘোষণার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় যুবলীগ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, এই রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, ব্যক্তি নন, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না, এই রায় তারই সাক্ষ্য বহন করে। শাহে আলম মুরাদ বলেন, এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে এ রায় থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ দুর্নীতি থেকে বিরত থাকবে।
ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয় থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের পর্যবেক্ষণ করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে বসে মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তারা। রায় ঘোষণার পর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ও দলের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। এ সময় তিনি বলেন, এ রায়ে আওয়ামী লীগের সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হওয়ার বিষয় নয়। এটা সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়। এতে প্রমাণিত হয়েছে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এতদিন বলে আসছিলাম যে তারা অপরাধী তা প্রমাণিত হয়েছে। এ সময় ড. আবদুর রাজ্জাক, মুকুল বোস, আহমদ হোসেন, এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, অসীম কুমার উকিল, ফরিদুন্নাহার লাইলী, ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা, ইঞ্জিনিয়ার আবদুর সবুর, দেলোয়ার হোসেন, আমিনুল ইসলাম, বিপ্লব বড়ুয়া, এসএম কামাল, রেমন্ড আরেং, ইকবাল হাসান অপু, ডা. বদিউজ্জামান ভুইয়া ডাবলু, অধ্যাপিকা অপু উকিল, মাহমুদ হাসান রিপন উপস্থিত ছিলেন। ধানমন্ডি দলীয় কার্যালয়ের সামনে যুব মহিলা লীগের নেত্রীরা মানববন্ধন করেন। এ সময় অধ্যাপিকা অপু উকিল ও কোহেলী কুদ্দুস মুক্তিসহ কযেকশ নারী কর্মী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান বিভিন্ন ওয়ার্ড-থানা ও ইউনিটে নেতাদের উপস্থিতি মনিটরিং করেন। ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিল ও সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ফার্মগেট, মিরপুর, উত্তরাতে সক্রিয় অবস্থান নেন। একইভাবেই মহিলা আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগের নেতারা গোটা রাজধানীতে অবস্থান করেন। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটির মহাসচিব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সফিকুল বাহার টিপুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা জাতীয় প্রেস ক্লাব, পল্টন ও গুলিস্তান এলাকায় সতর্ক অবস্থান নেন। ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ফার্মগেট ও বাংলামোটর, বিজয় সরণিতে অংশ নেন উত্তর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়াও রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সদরঘাট এলাকাতে যাতে কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয় সেজন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নুল আবেদীন রাসেলের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা বুধবার রাত থেকেই পাহারা বসায় ওই এলাকায়। গতকাল সকাল থেকেই সতর্ক অবস্থানের পর রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ মিছিল বের করে তারা। ওয়ারী, কাপ্তান বাজার এলাকায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে সক্রিয় অবস্থান নেন ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু ও সাধারণ সম্পাদক হাজী আবুল হোসেন। রায় ঘোষণার পর তারা আনন্দ মিছিল বের করেন। ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লা সজলের নেতৃত্বে ঢাকার প্রবেশপথ শনির আখড়া এলাকায় এবং যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ মুন্না, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম অণুর নেতৃত্বে যাত্রাবাড়ীতে অবস্থান নেন নেতারা।
রায়কে কেন্দ্র করে নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে ভোর থেকেই ঢাকা-৪ আসনের এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার নেতৃত্বে রাজপথে অবস্থান নেন শ্যামপুর কদমতলী থানার জাতীয় পার্টির নেতারা। এলাকার দোলাইরপাড়, পোস্তগোলা ও শ্যামপুর ট্রাক স্ট্যান্ডের বিপরীতে মূল সড়কের পাশে জাতীয় পার্টির শত শত নেতা-কর্মী অবস্থান নেয়। এদিকে খালেদা জিয়ার রায়কে ‘জনগণের বিজয়’ আখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আনন্দ মিছিল করে ছাত্রলীগ। রায় ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে টিএসসি গিয়ে শেষ হয়। এতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন, ঢাবি শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। এর আগে রায়কে কেন্দ্র করে ঢাবি ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয় সংগঠনটির কেন্দ্রীয়, ঢাবির বিভিন্ন হলসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতা-কর্মীরা। শাহবাগ, টিএসসি, কার্জন হল, পলাশী, নীলক্ষেতসহ ক্যাম্পাসের প্রবেশ মুখে সতর্ক প্রহরায় ছিল সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।বিএনপির বিক্ষোভ আদালতের বিরুদ্ধে : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় আদালতের, সরকারের নয়। তাই বিএনপির আজকের কর্মসূচি আদালতের বিরুদ্ধে। গতকাল সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সরকার নয়, রায় দিয়েছে আদালত। নেতা-কর্মীদের বলব, এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। মারামারি, লাফালাফি, দাপাদাপির কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা ঠাণ্ডা মাথায়, সতর্কভাবে, রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করব। তিনি বলেন, আদালতের রায়কে তারা সংবিধানবিরোধী বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। রায়কে ঘিরে তারা যে তাণ্ডব চালিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সতর্ক থাকায় তা সফল হয়নি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার দুর্নীতির বিচার হয়েছে। এতে করার কী আছে? ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথা শুনে অবাক হলাম, তিনি কী করে বললেন, এই রায় সরকার দিয়েছে? আদালতের ওপর আস্থা থাকলে তিনি এ কথা বলতে পারতেন না। তারা একদিকে শান্তির কথা বলছেন অন্যদিকে সহিংসতা করছেন।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতেই এই রায় কিনা-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা হলেও তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন-এটা বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মন্তব্য।
সংবাদ সম্মেলনে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক আবদুস সাত্তার, কার্যনির্বাহী সদস্য এস এম কামাল হোসেন, মারুফা আক্তার পপি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।