শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ছড়াছড়ি

আসক্ত হচ্ছে স্থানীয়রাও, ইয়াবাসেবীদের দৌরাত্ম্য, বেড়েছে চুরি-ডাকাতি

ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

উখিয়া ও টেকনাফের স্থায়ী-অস্থায়ী সব ক্যাম্পেই মাদকের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজা ও যৌন উত্তেজক বিভিন্ন টনিক। ইয়াবা সেবন ও পাচারকর্মে জড়িয়ে পড়েছে কিশোর-কিশোরী এবং রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণীরা। ইয়াবার বড় বড় চালান নিয়ে ধরাও পড়ছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। তাদের সঙ্গে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে স্থানীয় উঠতি বয়সী তরুণরাও। ইয়াবাসেবীদের দৌরাত্ম্যে ক্যাম্পের সাধারণ আশ্রিতরা এখন বীতশ্রদ্ধ। ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকাগুলোতে বেড়েছে চুরি-ডাকাতির ঘটনা। মাদকসেবনের টাকা জোগাড় করতে রোহিঙ্গা তরুণরা মরিয়া হয়ে চুরি-ডাকাতির মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে জানালেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয়রা। ক্যাম্পগুলোতে নিয়মিত র‌্যাব ও পুলিশের অভিযান চললেও বিশাল এই রোহিঙ্গা গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে বিপাকে পড়েছে বাহিনীর সদস্যরা। সরেজমিন ক্যাম্প ঘুরে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে এখন মাদক। সন্ধ্যা নামলেই ছোট ছোট দল ক্যাম্পগুলোর ঝুপড়ির কোনাঘুপছিতে এবং পাহাড়ের আড়ালে বসে ইয়াবা সেবনের মচ্ছব চালায়। তরুণদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা তরুণীদের একটি অংশও মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময়ও কেউ কেউ নিয়ে আসে ইয়াবা। এপারে থিতু হতে না হতেই একটি চক্র শুরু করে দিয়েছে  ইয়াবা পাচারের কাজ। এখন দিন দিন বেড়েই চলেছে মাদকের আগ্রাসন। গত দুই মাসে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে অন্তত ১৫টি ছোট বড় ইয়াবার চালান। আটক করা হয়েছে ২০ জনের মতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদকের ভয়াবহতার কথা স্বীকার করে উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মাকসুদুল আলম বলেন, ‘এখন রোহিঙ্গারা সবার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের হাতে হাতে ইয়াবা। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে ইয়াবা পাচার রোধ ও মাদক থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা চালালেও তা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।’ এদিকে, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবাধে বিক্রি হতে দেখা যায় যৌন উত্তেজক টনিক ও মদ। বিকৃত ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে একটি চক্র এসব বিক্রি করায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাড়ছে আরও অসামাজিক কার্যকলাপ। আকর্ষণীয় মোড়ক ও চটকদার বিজ্ঞাপনী ভাষার আড়ালে বিক্রি হয় এসব সিরাপজাতীয় টনিক। যার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের মধ্যেই। রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মাত্রাতিরিক্ত ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে আসছে দেশি-বিদেশি এনজিওরা। এই সুযোগে তারা ক্যাম্পে শুধু খেয়ে শুয়ে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। অতিরিক্তি ত্রাণ বিক্রি করে সাধারণ মাদকসেবীরা মাদকের টাকা জোগাড় করছে। যারা পারছে না তারা চুরি-ডাকাতিতে নেমেছে। আবার কেউ কেউ বাংলাদেশে বসে কীভাবে প্রচুর টাকার মালিক হওয়া যায়, সে চিন্তা থেকে নেমে পড়েছে মাদক ব্যবসায়। ভূরি ভূরি মাদকের চালান নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। আইন-কানুনকেও ভয় করে না অক্ষরজ্ঞানহীন এসব রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং স্থায়ী রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের বাইরের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প থেকেই এখানে মাদকসেবন ও ব্যবসার সূত্রপাত হয়। আর এ কাজে রোহিঙ্গাদের সব ধরনের মদদ দিয়েছে স্থানীয় বখতেয়ার মেম্বার নামে এক প্রভাবশালী। সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এই সাবেক ইউপি সদস্য ওই এলাকাকে মাদকের আখড়ায় পরিণত করেছে।

আর এখান থেকে অল্পদিনের মধ্যেই মাদকের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে ১৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। মাদকের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গারা কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করে না। তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে স্থানীয় কিশোর ও উঠতি যুবকরা। তারাও মাদক সেবন ও পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের মতে—রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুধু মাদক নয়, অস্ত্র, পতিতাবৃত্তি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যা প্রতিদিন ঘটছে না। স্থানীয় অভিভাবক মহল নিজেদের ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় বসবাস করছে। এসব অপকর্মে কখন জড়িয়ে পড়ে তাদের সন্তান-সন্ততিও। উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা বলেন, ‘অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ইয়াবা বহনকারী হিসেবে জড়িত। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা নিয়ে এসে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হচ্ছে।’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ছড়াছড়ির সম্পর্কে কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের ইনচার্জ (উপ-সচিব) রেজাউল করিম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এমনিতেই অপরাধ প্রবণ, তা নতুন কিছু নয়। ইতিপূর্বেও মাদক পাচার, জাল নোট এবং অস্ত্র তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকার মতো বহু ঘটনার সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার বিষয়গুলো প্রমাণিত সত্য। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা আমাদের প্রশাসনের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসঙ্গে এত রোহিঙ্গার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরা এতটাই অপরাধ প্রবণ যে, প্রায় প্রতিদিন ক্যাম্পে শতাধিক ঘটনার শালিসী বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হয়।’

সর্বশেষ খবর