শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

কৃষিতে ঝুঁকছে শিক্ষিত তরুণরা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

কৃষিতে ঝুঁকছে শিক্ষিত তরুণরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা সোহেল রানা নওগাঁর সাপাহারে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার —বাংলাদেশ প্রতিদিন

পড়াশোনা শেষ হতেই হাতে আতশি কাচ নিয়ে চাকরির বাজারে নেমে পড়েন শিক্ষিত তরুণরা। লক্ষ্য একটাই যেভাবে হোক ঘোচাতে হবে কপালে ঝুলে যাওয়া বেকার উপাধি। নামমাত্র বেতনের আশায় রাজধানীমুখী হন তারা। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সোহেল রানা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষে অন্য বন্ধুরা চাকরিযুদ্ধে নামলেও নিজের কিছু করার নেশায় ও পথে হাঁটেননি সোহেল রানা। নওগাঁর প্রত্যন্ত এলাকা সাপাহারে ‘রূপগ্রাম অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামে গড়ে তুলেছেন সমন্বিত কৃষি খামার। মাছ, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, দেশি মুরগি, কবুতর, পাখি, আম, লিচু, থাই পেয়ারা, মাল্টা, ড্রাগন, লেবু, প্যাসন ফল, পিচ ফল, জামরুল, খাটো জাতের নারিকেল, শাক-সবজিসহ প্রায় ৪০ জাতের ফলের গাছ আছে। এ ছাড়া বাসক, তুলসী, কালোমেঘ, অর্শগন্ধা, ঘৃতকুমারীসহ নানা জাতের ঔষধি গাছ আছে তার খামারে। কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার না করে পুরোপুরি প্রাকৃতিক উপায়ে চেষ্টা করছেন ফল ও ফসল উৎপাদনের। সোহেল রানার মতো অনেক তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন সমন্বিত কৃষি খামার। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কৃষিসহ মাছ, ছাগল, মুরগি, মধু, দেশি-বিদেশি ফল, ফুল চাষের উদ্যোগ নিচ্ছেন। নিজেদের সচ্ছল করে তৈরি করছেন কর্মসংস্থানের পথ।

এ উদ্যোগের বিষয়ে সোহেল রানা বলেন, আমাদের কৃষি নির্ভর দেশে কৃষি সবচেয়ে অবহেলিত পেশা। তরুণরা পেশা হিসেবে কৃষিকে বেছে না নেওয়ার একটা প্রবণতা চালু রয়েছে। এই বৃত্ত ভেঙে প্রাকৃতিক উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তি সহায়তায় সমন্বিত কৃষিতে তরুণদের  অংশগ্রহণ বৃদ্ধিই আমার লক্ষ্য। সার, বিষ, ফরমালিন ভেজালের বেড়াজাল থেকে প্রাকৃতিক কৃষির সুবাতাস পৌঁছে দিতেই এ উদ্যোগ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ফল উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। আর এসব সাফল্যের ধারায় তরুণদের অংশগ্রহণ যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, কৃষি ও সমন্বিত খামারের উদ্যোগ নিয়ে তরুণরা বিস্ময়কর সফলতা অর্জন করছে। তাই আগ্রহী তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে প্রকল্প এবং বিনামূল্যে বীজ ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছি আমরা। সনাতন পদ্ধতিকে বদলে আধুনিক পদ্ধতির কৃষিকে এগিয়ে নিতে শিক্ষিত তরুণরা এখন কাণ্ডারির ভূমিকায়। প্রাকৃতিক উপায়ে পরিবেশবান্ধব কৃষিতে উৎসাহিত করতে প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে পড়াশোনা শেষ করেন দেলোয়ার জাহান। মানিকগঞ্জে দেড় একর জায়গায় কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। অনার্সে দ্বিতীয় এবং মাস্টার্সে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিলেন দেলোয়ার। এরপর সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির সুযোগ পেয়েও যাননি। মা-মাটির প্রতি ভালোবাসা আঁকড়ে কৃষি কাজ শুরু করেন তিনি। নিজে তো বিষ ব্যবহার করেনই না, অন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষি কাজের। ফসলের খেতে প্রতি মিনিটে ৭২ কেজি ‘বিষ’ ছিটানো হয় বলে তার মন্তব্য। দেলোয়ার ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছেন ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ নামে একটি সংগঠন। ২০১৩ সালে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলী গ্রামে জমি লিজ নিয়ে গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদন শুরু। বর্তমানে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার হাজীপুর গ্রামে দেড় একর জমিতে প্রায় ৪০ রকমের সবজি উৎপাদন করছেন তিনি। ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ সংগঠনের মাধ্যমে কৃষকদের পরিবেশবান্ধব উপায়ে কৃষিকাজে উৎসাহিত করছেন তারা। তাদের উৎপাদিত সবজি, ফল ঢাকায় বিক্রির জন্য মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে ‘প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র’ চালু করা হয়েছে। কৃষিতে তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে বলে জানান দেলোয়ার। চুয়াডাঙ্গা সদরের তরুণ আলিমুজ্জামান ও ফিরোজুল হক দুজন উচ্চ শিক্ষিত তরুণ। আলিমুজ্জামান ঢাকার নর্দান  ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছেন আর ফিরোজুল হক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। দুজনে মিলে ১০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। উৎপাদন করছেন ফল ও শাকসবজি। ঢাকা কলেজে মাস্টার্স পড়ার পাশাপাশি নিজের এলাকা রাজবাড়ীতে কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন আমিরুল ইসলাম আমির। নিজের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় বর্গা নিয়ে ধানসহ বিভিন্ন রকমের সবজি উৎপাদন করছেন তিনি। এ স্বীকৃতি স্বরূপ কৃষি বিভাগ থেকে পেয়েছেন সম্মাননাও।  শিক্ষিত তরুণরা পুরো বাংলাদেশের কৃষির চিত্র পাল্টে দিচ্ছে। পিরোজপুরের তরুণরা সমতল ভূমিতে মাল্টা চাষে সফল হয়েছে। সাভার ও কালিয়াকৈরে সবজি চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে তরুণরা। রাজশাহীতে আম আর ধানচাষে সূচনা করেছেন নতুন দিগন্তের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে তরুণরাই এখন কৃষির প্রাণ। কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০-৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ। রাজধানীর বাড্ডাতে টার্কি খামার গড়ে তুলে সাড়া ফেলেছেন প্রকৌশলী শাহীন হাওলাদার ও তরুণ উদ্যোক্তা মিরাজ হোসেন। মাত্র ছয়টি টার্কি দিয়ে শুরু করে এখন তার খামারে ২০০-এর বেশি টার্কি পালন করা হয়। মৎস্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. গোলজার হোসেন বলেন, বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। আমাদের মূল টার্গেট তরুণদের প্রশিক্ষিত করা ও সমন্বিত প্রকল্পে উৎসাহিত করা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর