শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-১৪

রূপলালের সেই রূপ আর নেই

মাহবুব মমতাজী

রূপলালের সেই রূপ আর নেই

রূপলাল হাউসের সেই রূপ আর নেই। এখন এটি নিত্য পণ্যের আড়তে পরিণত হয়েছে। আর চিহ্নিত হয়ে আছে রাজধানী ঢাকার অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে। অথচ বিংশ শতকে আহসান মঞ্জিলের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রূপলাল হাউস। গ্রিক স্থাপত্যকলার অনুসরণে তৈরি সুরম্য অট্টালিকাটি এখন পোড়োবাড়ি। কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভবনের দেয়ালে দেয়ালে বেড়ে উঠছে শূন্যলতা। অযত্ন আর অবহেলার ছাপ গোটা বাড়িতে। একটা একটা বছর যায় আর রূপলাল হাউস তার রূপ হারিয়ে আরও মলিন হয়। ১৮২৫ সালে আর্মেনিয়ান জমিদার আরাতুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই ভবন। পরবর্তীতে ১৮৩৫ সালে রূপলাল দাস এবং তার ভাই রঘুনাথ দাস বাড়িটি কিনে নেন। সেই থেকে বাড়ির নাম হয় রূপলাল হাউস। তখনকার যুগের অত্যন্ত ব্যয়বহুল স্থাপত্য ছিল এ বাড়ি। উপর থেকে দেখলে বাড়িটিকে ইংরেজি ‘ই’ আকৃতিতে মনে হবে। নকশা করেছিলেন কলকাতার মার্টিনা কোম্পানি। এখানে নিয়মিত সংগীতের আসর বসত। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ওয়ালী উল্লাহ খান এবং লক্ষ্মী দেবীসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি সংগীত আসরে আসতেন নিয়মিত। ভবনের প্রতিটি কোনায় রয়েছে তাদের ছোঁয়া।

জানা যায়, ১৮৮৮ সালে ভাইস রয় লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরে এলে তার সম্মানে বল-ড্যান্সের আয়োজন করতে রূপলাল হাউসের হলঘরটি দুই দিনের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। নাচের আয়োজন ও লর্ড ডাফরিনকে সংবর্ধনা জানাতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। সেই সময়ে শুধু ঢাকার আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউসেই বল ড্যান্সের উপযোগী বিশাল হলঘর ছিল। তখনকার দিনে বিদেশিরা ঢাকায় এলে রূপলাল হাউসে বোর্ডার হিসেবে ভাড়া থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এখন রূপলাল হাউসের অন্দর-বাহির দুই বাড়ির পরিস্থিতি দেখলে আফসোসের শেষ থাকবে না। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করেও বহিরাগতদের জন্য বাড়িটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝ বরাবর কোনো নৌযান থেকে সরাসরি উত্তরে শ্যামবাজারের দিকে তাকালে সহজে প্রাচীন স্থাপত্য রূপলালের দেখা মিলবে।

পুরনো ছবি দেখলে এই বাড়িটিকে সেই কাঙ্ক্ষিত বাড়ি অর্থাৎ রূপলাল হাউস হিসেবে বিশ্বাস হবে না। চারপাশ পুরো একটা বাজারে পরিণত হয়েছে। বাড়িটি ঘিরে এখন অর্ধশতাধিক মসলা ও সবজির দোকানপাট। ঢোকার সময় জামাল হাউস, নুরজাহান হাউস ও রফিক ট্রেডার্সসহ বিভিন্ন নামের মরিচ-পিয়াজের আড়তখানা চোখে পড়বে। জিজ্ঞাসা করলে—স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, এটাই রূপলাল হাউস। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় দাস পরিবার ঢাকা ছেড়ে ভারত চলে যাওয়ার পর ১৯৫৮ সালে মোহাম্মদ সিদ্দিক জামাল রূপলাল হাউসটি কিনে নেন। এরপর এর নতুন নাম রাখা হয় ‘জামাল হাউস’। সরেজমিন দেখা যায়, ভিতরে পুরো বাড়িটি অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শুধু মাঝখানের উঠানটায় রোদের আলো পড়ছে।

গেট দিয়ে ঢোকার পরেই উপরে ওঠার সিঁড়ি। ফরাশগঞ্জের বাসিন্দা মাসুদ আলম এ প্রতিবেদককে জানান, মূল ভবনের সামনেই দোকানপাট বসিয়ে বাড়িটি ঘিরে ফেলা হয়েছে। তাও কোনো ভাসমান দোকান নয়, একেবারে পার্মানেন্ট। ছোটবেলায় বাড়িটি আমরা যেভাবে দেখেছি, এখন তো চেনার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। দোতলা এই বাড়ির দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৪৪৪ মিটার। দোতলার দুই ব্লকে বিভিন্ন আয়তনের ঘর আছে ৫০টির বেশি। উত্তর-দক্ষিণজুড়ে আছে প্রশস্ত বারান্দা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও জমকালো অংশ হলো দোতলার নাচঘর। নাচঘরের মেঝে কাঠের তৈরি আর সিলিংয়ে আছে কাচ ও কাঠের এক অপূর্ব সমন্বয়। এ ঘরের দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গামুখী বিশাল বারান্দা। এটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম।

 বারান্দায় কারুকার্যখচিত ভারী লোহার গ্রিল। দোতলার পশ্চিমে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।

আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, রূপলাল হাউসকে ‘হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তারপরও রূপলাল হাউস রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন, সুরম্য এই বাড়িটি আজ ধ্বংসের পথে। এখনই কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পুরান ঢাকার সব ইতিহাস, সব স্থাপত্যকলা হয়তো বইয়ে জায়গা করে নেবে এক দিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর