সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

হঠাৎ কেন এত বজ্রপাত

বাবা-ছেলেসহ সারা দেশে নিহত ২২

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঝড়-বৃষ্টির সময় ভ্যান চালিয়ে মাগুরা জেলা সদর থেকে শ্রীপুরের দিকে যাচ্ছিলেন শামীম। পথে বজ্রপাতে আহত হন তিনি। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শুধু শামীম নয়, গতকালের বজ্রপাতে সারা দেশে ২২ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিবছরই বাড়ছে বজ্রপাতে প্রাণহানি ও সম্পদহানির ঘটনা। কিন্তু হঠাৎ কেন বাড়ছে বজ্রপাতের ঘটনা তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, বিদ্যুত্প্রবাহ মানুষের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে মানুষ যেভাবে দ্রুত শক্ড হয়, ঠিক একইভাবে বজ্রপাতেও মানুষ শক্ড হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। তিনি বলেন, ইদানীং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এ কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, যত্রতত্র মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসানো, তাপমাত্রা  বৃদ্ধিও বজ্রপাতের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান খান বলেন, মানুষ খোলা আকাশের নিচে যখন কাজ করে, তখন বজ পাতে বেশি আক্রান্ত হয়। এ জন্য একটু সতর্ক হলেই নিজেকে রক্ষা করা যাবে। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যেতে হবে। হাওর ও উন্মুক্ত এলাকায় বড় গাছ তো দূরের কথা, কোনো গাছপালাই থাকে না। উঁচু গাছের নিচে দাঁড়ানো যেতে পারে। কিন্তু বেশি সময় গাছের নিচে থাকা যাবে না। এ জন্য নিরাপদ ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বজ পাতের আগে মানুষের মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। এটা একটা সতর্কবার্তা। তখনই দ্রুত সাবধান হতে হবে। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, বজ পাত সারা বছরই কম-বেশি হয়। তবে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বজ পাতের হার বেড়ে যায়। দেশে পাঁচটি জেলা সবচেয়ে বেশি বজ পাতপ্রবণ। এগুলো হচ্ছে শ্রীমঙ্গল, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও সৈয়দপুর। এই পাঁচটি জেলায় বছরে গড়ে ৩২৪, ৩২৪, ২০৬, ১৯৫ ও ১৭৯টি বজ পাত ঘটে। আর রাজধানীতে গড়ে বছরে বজ পাত ঘটে ১২৪টি।

বাবা-ছেলেসহ সারা দেশে নিহত ২২ : ৯ জেলায় ঝড়-বজ্রপাতে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে বাবা-ছেলেসহ পাঁচ, গাজীপুর ও মাগুরায় চারজন করে, বগুড়া, নোয়াখালী, নওগাঁয় দুজন করে এবং একজন করে মারা গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙামাটি ও সুনামগঞ্জে। গতকাল ঝড়-বজ পাতের এ সব ঘটনা ঘটে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

সিরাজগঞ্জ : শাহজাদপুর উপজেলার ছয়আনি, কাজিপুরের ডিগ্রি তেকানী চর ও কামারখন্দ উপজেলার পেস্তককুড়া গ্রামে গতকাল বজ পাতে বাবা-ছেলেসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরও চারজন। নিহতরা হলেন— ছয়আনি গ্রামের ফারুক খানের ছেলে নাবিল (১৭), রাশেদুল ইসলামের ছেলে পলিন (১৫), ডিগ্রি তেকানী গ্রামের শামছুল মণ্ডল (৫৫) ও তার ছেলে আরমান (১৪) এবং কামারখন্দের পেস্তককুড়ার আহের মণ্ডলের ছেলে কাদের হোসেন (৩৭)। জানা যায়, সকালে আম কুড়াতে গিয়ে বজ াঘাতে মারা যান নাবিল ও পলিন। এ ঘটনায় আহত চারজনকে শাহজাদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কাজিপুর ইউপি চেয়ারম্যান হারুন-অর রশিদ জানান, ডিগ্রি তেকানী চরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাদাম তুলছিলেন শামছুল। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ পাতে দুজনই আহত হন। কাজিপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়ার পথে বাবা ও ছেলের মৃত্যু হয়। অপরদিকে পেস্তককুড়ায় বাড়ির পাশে ধান খেতে কাজ করার সময় বজ পাতে মারা যান কাদের। গাজীপুর : কালিয়াকৈর উপজেলার মাটিকাটা এলাকায় সকালে বজ পাতে জাফিরুল ইসলাম (২০) নামে  পোশাক কারখানার এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। তিনি ইনক্রেডিবল ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার শ্রমিক ছিলেন। ঘটনার পর কারখানা এক দিনের ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এদিকে সকালে উপজেলার বোয়ালী এলাকায় ঝড়-বৃষ্টির সময় মাটির ঘরের দেয়াল চাপায় বৃদ্ধা ও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন— কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী এলাকার শুরিবালা (৬০) ও মরণ সরকারের দেড় বছরের মেয়ে মনষা। এ দুটি ঘটনায় আহত হয়েছেন সাতজন। এদিকে শ্রীপুরে বজ পাতে একজন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। উপজেলার ধলাদিয়া গ্রামে গতকাল এ ঘটনা ঘটে। নিহত বিলকিস বেগম (৪২) ধলাদিয়া গ্রামের কালু কবিরাজের স্ত্রী। তার ছেলে জহিরুল ইসলাম (২১) আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাগুরা : সদর উপজেলার কামারবাড়ি এলাকায় দুপুরে বজ পাতে শামীম (২৫) ও আলম (৩৫) নিহত হয়েছেন। শামীমের বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার জোকা গ্রামে আর আলম সদর উপজেলার রায়গ্রামের বাসিন্দা। একই সময় শালিখা উপজেলার বুনাগাতি গ্রামে বৈদ্যুতিক টাওয়ারে কাজ করার সময় ঝড়ে নিচে পড়ে মেহেদী নামে শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি জয়পুরহাটে। তিনি বিদ্যুৎ টাওয়ারের কাজ করতে এসেছিলেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া জেলায় মাঠে কাজ করার সময় বজ পাতে মারা যান প্রল্লাদ বিশ্বাস নামে এক  শ্রমিক। বগুড়া : গাবতলীতে বজ পাতে মহিলাসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার কালাইহাটা গ্রামের ডাবলু মণ্ডল (৩৫) স্থানীয় জমিতে ধান কাটতে গেলে বাজ পড়ে তিনি মারা যান। অপরদিকে দুপুরে বজ পাতে মৃত্যু হয়েছে দক্ষিণপাড়া গ্রামের আবদুল হামিদের স্ত্রী সাজু বেগমের। নোয়াখালী : নোয়াখালী পৌরসভার লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে গতকাল দুপুরে মাঠে খেলার সময় বজ পাতে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ইকবাল হাসনাত পিয়ালের (১৩) মৃত্যু হয়েছে। সে ওই গ্রামের সোহেল রানা জগলুর বড় ছেলে। এদিকে সেনবাগের নবীপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে বজ পাতে ধান কাটা অবস্থায় শাহিন (১৬) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। শাহিন (২৬) ভোলার তজুউদ্দিন উপজেলার সোনাপুর গ্রামের রজন মিয়ার ছেলে। এ সময় আব্বাস ও মনির নামে দুই শ্রমিক আহত হয়েছে। নওগাঁ : সাপাহারে সোনাভান (২০) নামে এক গৃহবধূর বজ াঘাতে মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন সোনাভানের স্বামী রুবেলসহ তিনজন। ঘটনাটি ঘটে গতকাল সকালে উপজেলার শিমুলডাঙ্গা রামাশ্রম গ্রামে। এদিকে পোরশা উপজেলায় দুপুরে মাঠ থে?কে ছাগল নিয়ে ফেরার সময় বজ পা?তে মুক্তার হোসেন নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। মুক্তার বা?লিয়াচান্দা গ্রামের বদরু?জ্জামানের ছেলে ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : আখাউড়ায় বজ পাতে আ. রহিম (৪৫) নামের এক ধান কাটার শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে। এ সময় আরও একজন আহত হন। উপজেলার দরুইন গ্রামে গতকাল সকালে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রহিমের বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায়। রাঙামাটি : বাঘাইছড়িতে বজ পাতে মানছুরা বেগম (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার মারিশ্যা ইউনিয়নের মুসলিম ব্লক এলাকায় গতকাল এ ঘটনা ঘটে। মানছুরা ওই গ্রামের অছির আহম্মেদের স্ত্রী। সুনামগঞ্জ : সদর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে বজ পাতে মারা গেছেন ললিত মিয়া (৩০) নামে এক কৃষক। সকালে বাড়ির পাশে ধান খেতে কাজ করার সময় বজ আঘাতের শিকার হন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর