শুক্রবার, ৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-৩৫

আত্মীয়সভা থেকে দেড়শ বছরের ব্রাহ্মসমাজ

মাহবুব মমতাজী

আত্মীয়সভা থেকে দেড়শ বছরের ব্রাহ্মসমাজ

পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ব্যস্ত সড়ক থেকে বোঝার উপায় নেই পঞ্চাশ গজের মধ্যেই এমন সুন্দর ছিমছাম এক পরিবেশ। গেট পেরোলেই লোহার রেলিংঘেরা ফুলের বাগান। সেখানে রয়েছে হরেক রকমের গাছ। ফুলের দেখা কম হলেও সবুজের কমতি নেই। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে সাদা ও লাল রঙের মিশেলে দোতলা সমান উঁচু একতলা ভবন। চূড়ায় নকশাদার ফলকে সাদা রঙে লেখা ব্রাহ্মসমাজ। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের মন্দির। পাশেই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। এখন অবশ্য ব্রাহ্মসমাজের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। এর সদস্য দিন দিন কমছেই বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা। নেহাত পালা-পার্বণেই কিছুটা লোকসমাগম হয়। সাপ্তাহিক প্রার্থনায় পাওয়া যায় হাতেগোনা  কয়েকজনকে। জানা যায়, বেদান্তের একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ গঠন করেন। পরে এটি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্রাহ্মরা নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করেন। এই সমাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ও কুসংস্কার দূর করা। এর সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেনসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির নাম জড়িয়ে আছে। পাটুয়াটুলীতে ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে প্রতি রবিবার সন্ধ্যা ৬টার পর প্রার্থনা হয়।

ব্রাহ্মসমাজের মন্দির চত্বর ঘুরে জানা গেল আদ্যোপান্ত। ব্রাহ্মদের মধ্যে দুটি ভাগ। তা হলো জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম ও অ-আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম। হিন্দুদের মধ্যে যারা ব্রাহ্মধর্ম সমর্থন করেন, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেননি, তারাই অ-আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম। তারা সমাজের সদস্যও হতে পারেন। এ ছাড়া দীক্ষালাভের মাধ্যমেও ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হওয়া যায়।

এ সমাজ গঠনের নেপথ্য : সতীদাহ প্রথা বাতিলসহ নানা সংস্কারমূলক কাজের জন্য রাজা রামমোহন রায়কে ঘিরে শুভাকাঙ্ক্ষীদের একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এদের নিয়েই ১৮১৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘আত্মীয়সভা’। প্রতি সপ্তাহে এক দিনের অধিবেশন হতো বিভিন্ন সদস্যের বাড়িতে। সেখানে উপস্থিত থাকতেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, গোপীমোহন ঠাকুর, কালীশঙ্কর ঘোষাল, রাজনারায়ণ সেন, কৃষ্ণমোহন মজুমদার, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, নন্দকিশোর বসু প্রমুখ। আর এই আত্মীয়সভাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ব্রাহ্মসমাজ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশে মোট ব্রাহ্মের সংখ্যা ৬২। তবে জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম আছেন মাত্র ১৩ থেকে ১৫ জন। ব্রাহ্মসমাজের কার্যনির্বাহী কমিটি সাত সদস্যের। এ ছাড়া সাত সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডও আছে। তারা মন্দিরসহ সব সম্পদের দেখভালের দায়িত্বে। ১৮৬৯ সালে পুরান ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজের এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ও সুচিত্রা সেনের শ্বশুর দীননাথ সেন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই সময় ভবনটি নির্মাণে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। তখন বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজ পরিচিত ছিল ‘ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ’ নামে। এখন ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে আচার্যের দায়িত্বে আছেন দীপক পাল। তিনি প্রার্থনাসভা পরিচালনা করেন। এ মন্দিরে জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব মানুষ আসতে পারেন। বিশেষ কিছু দিনে মন্দিরে উৎসবের আয়োজন করা হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে বাংলা সনের ১১ মাঘ বিশেষ কর্মসূচি পালিত হয়। ১৯২৬ সালে এই মন্দিরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। তিনি এখানে প্রার্থনা করেছিলেন। মন্দিরের প্রার্থনা ঘরে একটি বেদি আছে। তার চারপাশে বেঞ্চের সারি। সেখানে বসেই ঈশ্বরের আরাধনা চলে। রবি ঠাকুরের গানের ফাঁকে ফাঁকে আচার্য বৈদিক মন্ত্র পড়ে শোনান।  ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি জানান, এখানে বেদের সঙ্গে সঙ্গে কোরআন, ত্রিপিটক, গীতা, গুরু দুয়ারা নানক শাহী ও বাইবেলও পাঠ করা হয়। এ ছাড়া পয়লা বৈশাখ রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করেন ব্রাহ্মরা। এখন খুবই স্বল্প পরিসরে এ ধরনের কাজ হচ্ছে। এসব কার্যক্রম ছাড়াও তারা শীতকালে গরিব মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ করে থাকেন। কখনো সহায়সম্বলহীন অসুস্থ ব্যক্তিদের ওষুধ কিনে দেওয়ারও কাজ করেন।

সর্বশেষ খবর