রবিবার, ১০ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

সেই ডাক্তার কেন অস্ত্রধারী

কিলিং মিশন নিয়ে চাঞ্চল্যকর যত তথ্য

সাখাওয়াত কাওসার

সেই ডাক্তার কেন অস্ত্রধারী

ছোটবেলা থেকেই জাহিদুল আলম কাদিরের অস্ত্রের প্রতি ঝোঁক। নতুন চকচকে অস্ত্র দেখলেই সংগ্রহে রাখতেন। অনেকটা শখের বশেই। একটা-দুটা করে রাখতে রাখতে একসময় অস্ত্রের ছোটখাটো ভাণ্ডারে পরিণত হয় তা। এরপর লেখাপড়ার পাশাপাশি অপরাধের নানা শাখায় তার অবাধ বিচরণ ঘটে। ঢুকে পড়েন আন্ডারওয়ার্ল্ডে। খুব অল্প সময়েই তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকার জগতে। অপরাধীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করেন। উন্নত মানের চকচকে বিদেশি সব অস্ত্র আমদানি করাতেন বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর মাধ্যমেই। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এমবিবিএস ডিগ্রিধারী হয়েও প্রাণ নেওয়ার কারিগর হিসেবে দক্ষ হয়ে উঠছিলেন তিনি। হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল হিসেবে মাঝেমধ্যেই ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ করতেন। মিশন বাস্তবায়ন করাতেন পেশাদার কিলারদের মাধ্যমেও। জাহিদুল আলম কাদিরকে চিকিৎসক হিসেবে সবাই জানলেও আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার পরিচয় ‘ভয়ঙ্কর জাহিদ’। মেধাবী এই চিকিৎসক কেন অস্ত্রধারী হলেন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন গোয়েন্দারা। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাবনা এবং কুষ্টিয়ায় স্কুল ও কলেজ-জীবন শেষ করে ১৯৯২ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন মেধাবী ছাত্র জাহিদ। মেডিকেল কলেজের ৩২ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। তবে ভালো ছাত্র হওয়ার পরও ছোটবেলা থেকেই অস্ত্রের প্রতি ঝোঁক ছিল তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়েছেন এমন একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিজের সংগ্রহে রাখতেন। জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের সক্রিয় রাজনীতিতে। মেডিকেল কলেজে তৎকালে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া, অন্য গ্রুপের প্রধান ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই। জাহিদ থাকতেন মেইন হোস্টেলে। প্রথম বর্ষে ডা. উত্তম গ্রুপের সঙ্গে থাকলেও তৃতীয় বর্ষে ওঠার পরই তিনি দল ত্যাগ করেন। যোগ দেন ডা. নিতাই গ্রুপে। এ নিয়ে মেডিকেল কলেজে ডা. জাহিদ ‘পলিথিন জাহিদ’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে তিনি মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের মুরাদ-সাদী কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পান। অস্ত্রের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন মাদকেও। ২০০২ সালে এমবিবিএস পাস করেন ডা. জাহিদ। তবে তিনি কখনো সরকারি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেননি। দেশের বিভিন্ন জেলায় বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে চাকরি করেন। গ্রেফতারের চার দিন আগে ময়মনসিংহের একটি ক্লিনিকে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘অ্যানেসথেসিয়া’ ডিপ্লোমা করেন জাহিদ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক ভিপি ডা. বিলিয়ম অনিমেষ সাংমা বলেন, ‘ডা. জাহিদ সহজ-সরল ছিল। তবে থ্রিলিং লাইফ পছন্দ করত। অস্ত্রের প্রতি তার মারাত্মক ঝোঁক ছিল। অনেকটা শখের বশেই অস্ত্র সংগ্রহে রাখত সে। তবে সে কন্ট্রাক্ট কিলার হতে পারে তা আমরা কখনো বিশ্বাস করি না। এতে অন্য কোনো ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে।’ ১৫ মে যাত্রাবাড়ী থেকে দুটি পিস্তল ও আট রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করা হয় ডা. জাহিদকে। অস্ত্র আইনে মামলায় রিমান্ডে নিয়ে ৩ জুন গাবতলী থেকে তার স্ত্রী মাসুমা আক্তারকে একটি বিদেশি পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল। ৭ জুন জাহিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ময়মনসিংহের বাগমারা এলাকা থেকে ১২টি অস্ত্র ও ১৬১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তৃতীয় দফায় রিমান্ডে রয়েছেন ডা. জাহিদ। আজ রিমান্ড শেষে তাকে পুনরায় রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করবেন তদন্ত কর্মকর্তা। ডা. জাহিদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত তিনজন সন্ত্রাসীর কথা বলেছেন জাহিদ। তাদের মধ্যে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বাসিন্দা পেশাদার কিলার তাজুল মাঝেমধ্যেই তার কাছ থেকে অস্ত্র ভাড়ায় নিতেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতেন তিনি। উদ্ধার করা ১৫টি অস্ত্রের মধ্যে মাত্র তিনটি ভারতীয়। বাকিগুলো তাওরাস, রোজার, এসট্রা, টিটাস। তিনি বলেন, র‌্যাবের সোর্সের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে এই তাজুল একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৫টি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার ৬২২ রাউন্ড গুলির বেশির ভাগ তিনি ময়মনসিংহের গাঙ্গিনারপাড়ের খান আর্মসের কর্ণধার মো. শাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে কিনেছেন। তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এবার শাহাবুদ্দিন ও ডা. জাহিদকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

জাহিদ জানিয়েছেন, তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকেই পাস করা চিকিৎসক। বাড়ি ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ এলাকায়। ওই সংসারে তার এক ছেলে রয়েছে। তবে বিয়ের তিন বছর পরই তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে চার বছর আগে মাসুমাকে বিয়ে করে ময়মনসিংহে বসবাস করছিলেন জাহিদ।

এদিকে জাহিদের প্রথম স্ত্রী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অপকর্ম থেকে জাহিদকে সরাতে অনেক চেষ্টা করেছি। তবে কোনো কাজ হয়নি। ডিভোর্স নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না।’

জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের বরাত দিয়ে কাউন্টার টেররিজমের স্পেশাল অ্যাকশন টিমের উপকমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ অস্ত্রের কারবারে জড়িয়ে পড়েন জাহিদ। ১৯৯৩ সালে তিনি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন। অতি সম্প্রতি তাজুলকে দিয়ে সিলেটে জাপার একজন সংসদ সদস্যকে ‘ভাড়ায় খুন করার ছক’ আঁকেন তিনি।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্ত্র ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন খান বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করতেন। বিদেশ থেকে অস্ত্র নিয়ে এসে জাহিদের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে দিতেন।

আমাদের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জহুরুল হক জানিয়েছেন, কুষ্টিয়ার পোড়াদহের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান জাহিদ। বাবা হাবিবুর রহমান রেলওয়ের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। বড় ভাই প্রকৌশলী। বোনদের সবাই উচ্চশিক্ষিত। জাহিদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি সন্ত্রাসী এবং তার অস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল এটা মানতে পারছেন তার বাবা-মা। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করার সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

গতকাল জাহিদের বাবা হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৫ মে জাহিদুলকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রায় এক মাস পর তাকে আটকের বিষয়টি জানানো হয়, এটি রহস্যজনক। এ ছাড়া তাকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে আটকের কথা বললেও আসলে তাকে কুমিল্লার কোম্পানীগঞ্জ থেকে আটক করা হয়। জাহিদ ওই দিন একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য কোম্পানীগঞ্জ গিয়েছিলেন। জাহিদের বাবা এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।

সর্বশেষ খবর