রবিবার, ১০ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাজেটের লক্ষ্য এক চ্যালেঞ্জ অনেক

রুকনুজ্জামান অঞ্জন ও আলী রিয়াজ

জাতীয় নির্বাচন আসন্ন বলে আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের লক্ষ্য ছিল একটাই— জনগণকে তুষ্ট করা। সেই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে যে বাজেট তিনি ঘোষণা করেছেন, তাতে অনেক চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বাজেট বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া প্রত্যাশিত বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজস্ব সংগ্রহ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, এডিপি বাস্তবায়নকেই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বাজেটের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ায় অনুৎপাদনশীল ও অপ্রত্যাশিত খাতে অতিরিক্ত ব্যয় হতে পারে। আবার রাজস্ব আহরণের তুলনায় ব্যয় বেশি হলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় মূল্যস্ফীতিকেও উসকে দিতে পারে। এসব ঘটলে বাজেটের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তখন বাজেট বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন আসছে। সরকার পরিবর্তন হতে পারে। সরকার পরিবর্তন হলে বাজেট বাস্তবায়নে কিছু ঘাটতি এমনিতেই তৈরি হবে। কিছু খরচ আছে, যা নির্বাচনী বছরে অনেকে করে থাকেন। পরবর্তী সরকার যারা আসবে, তাদের লক্ষ্য আরেক রকম হতে পারে। অন্যদিকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা যা ধরা হয়েছে তাও উচ্চাভিলাষী। শুধু এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। আমাদের যে করকাঠামো, তাতে এ অর্থ আদায় করা সম্ভব হবে না। বছর শেষে এর প্রভাব সব খাতে পড়বে। বাজেটেও ঘাটতি বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়ন করা অবশ্যই কঠিন হবে।’ বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েত বখত বলেন, নির্বাচনী বছর হিসেবে অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ বেশি হবে। এটা উন্নয়ন বাজেটে প্রভাব ফেলবে। অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা চলে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। এখানে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ কতটা কমানো যায়। তিনি বলেন, বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় কোনোভাবেই সম্ভব নয়। করহার বাড়ানো হয়নি। ফলে বেশি আদায়ের যে লক্ষ্য, তা কীভাবে অর্জিত হবে? তা অর্জন করতে হলে করের আওতায় সবাইকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু প্রচলিত আদায়ের পদ্ধতিতে তা কতটুকু সম্ভব! বাজেট বাস্তবায়নে তা বড় চ্যালেঞ্জ।

শুধু যে রাজস্ব আয় বা মূল্যস্ফীতি নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা-ই নয়, প্রবৃদ্ধি অর্জন ও বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকেও চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হলে বাজেটে ঘোষিত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ঝুঁকিতে পড়বে। সরকারের মেয়াদের শেষ ও প্রথম বছরে উদ্যোক্তারা নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় ভোগেন। তারা নতুন কোনো বিনিয়োগে আসতে চান না। সে অর্থে নির্বাচনী বছরের এ বাজেটে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী, সেখানেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জ রয়েছে এডিপি বাস্তবায়নেও। নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন প্রকল্প জনগণের সামনে দৃশ্যমান করার জন্য তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করার প্রচেষ্টা থাকতে পারে। এর ফলে প্রকল্পের গুণগত মান যেমন ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে, তেমন অর্থের অপচয় হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। বাজেটের স্বচ্ছতা ক্ষুণ্ন হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটের তিনটি ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। উন্নয়ন বাজেট নানা প্রতিবন্ধকতায় বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সমন্বয়হীনতা, ফান্ড ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জটিলতা রয়েছে। বাজেটে এ বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়নি। এসব সমস্যা সমাধানে সংসদে যেতে হয় না। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রতি বছরই এগুলোর জন্য এডিপি বাস্তবায়নে ঘাটতি থেকে যায়। বছর শেষে অর্থ খরচ করা যায় না।’ তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সময় ভূমি অধিগ্রহণ, আইনগত সমস্যা, ব্যবস্থপনাগত দক্ষতার অভাব দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকরা পুরো সময় প্রকল্প এলাকায় থাকতে চান না। এজন্য আগে বলা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালকদের একটি পুল করা হবে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, পুল তৈরি করা তো হয়নি, একটি তালিকা পর্যন্ত করা যায়নি। ফলে এডিপি বাস্তবায়নে এ বাজেটে একই ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। বিশ্বব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ভ্যাটকাঠামো নয়টি থেকে পাঁচটি করা হয়েছে। এটা ভালো কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু পুরো ভ্যাট সিস্টেম ও কর সিস্টেম অটোমেশনে আনা যায়নি। যদি পুরোটা অটোমেশনে আনা যেত, কর আদায় বাড়ত। এখন নজর দিতে হবে, যেন করের বাইরে কেউ না থাকে তার ওপর। কিন্তু এ কাঠামো দিয়ে তা কঠিন। ফলে প্রাক্কলিত রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে সুদ পরিশোধ। ব্যাংকনির্ভরতার কথা বলা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও সুদের ওপর কোনো পদক্ষেপ নেই। সঞ্চয়পত্র ঋণের সুদ পরিশোধ বাড়বে। ফলে যে টার্গেট করা হয়েছে তা রক্ষা করা যাবে না। সঞ্চয়পত্রের চাহিদা কমবে না বরং বাড়বে। যেহেতু কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেই, তাই সুদের চাপ অনেক বেশি হবে, যা বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি তৈরি করবে।

সর্বশেষ খবর