রবিবার, ১০ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাংক লুটেরাদের শাস্তি চায় এফবিসিসিআই

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের ব্যাংকিং খাতের লুটপাটকারীদের বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের এই শীর্ষ সংগঠনটি বলেছে, যারা ব্যাংকের টাকা তছরুপ করছে, টাকা চুরি করছে তাদের আমরা শাস্তি চাই। স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে ব্যাংকিং খাতে এখনো বিশৃঙ্খলা চলছে, যা আমাদের নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।  প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে শুরু থেকেই সুষ্ঠু মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এটা না হলে বাজেট বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে করে এফবিসিসিআই। গতকাল মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন- এফবিসিসিআইর প্রথম সহসভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম ও সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর এফবিসিসিআইর মতামত তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। লিখিত বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে। এতে সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার প্রস্তাব করছি- যাতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বজায় থাকে। জনগণের আমানতের পয়সা যাতে তছরুপ না হয়, সে জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিলে তাদের রক্ষার জন্য এফবিসিসিআই কোনো সুপারিশ করবে না। যারা খারাপ ব্যবসায়ী, কেউ কেউ পলিসি মনিপুলেশন করে, ব্যাংকের টাকা লুটপাট করে, তাদের জন্য এফবিসিসিআই এ্যাডভোকেসি করে না। আমরা চাই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অধিক ঋণ নেওয়ার কারণে উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা উৎপাদনশীল খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যাতে প্রতিবন্ধকতা বা বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করে সে বিষয়ে তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বাজেটে ব্যাংকিং খাতে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে তাতে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসবে আশা করছি। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমাজে দুই ধরনের খেলাপি আছে। প্রথমত ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে আর ফেরত দিতে চায় না। এ ধরনের যারা ব্যাংকের টাকা লুটপাট করছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এদের জন্য এফবিসিসিআই অ্যাডভোকেসি করবে না। দ্বিতীয়ত অনিচ্ছাকৃত খেলাপি। ব্যাংকের উচ্চ সুদ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, হরতাল-অবরোধের কারণে অনেক ভালো ব্যবসায়ীও খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। এদের গঠনমূলকভাবে সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মহিউদ্দিন বলেন, বাজেটে এনবিআরের রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি অর্জনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং আইন-কানুনের অপপ্রয়োগ ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতার কারণে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হয়ে থাকে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিবিড় মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।  এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আরও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর যুক্তি দেখিয়ে এফবিসিসিআই বলেছে, বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি, জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে আজকের বাজারে এ সীমা ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব করেছি। এফবিসিসিআই বলেছে, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের স্বার্থে ব্যাংকের মতো অন্য উৎপাদনশীল খাতেও করপোরেট হার আড়াই শতাংশ কমানো হোক। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, করপোরেট কর হার কমালে মুনাফার অংশ ব্যবসায়ীরা পুনঃবিনিয়োগ করতে পারবেন অথবা লভ্যাংশ বিতরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বেশি অবদান রাখবে। করপোরেট হার কমালে রাজস্ব কমে না। অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) প্রত্যাহার, করপোরেট কর হ্রাস, ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর সীমা বৃদ্ধি, অ্যাপসভিত্তিক সেবা পাঠাও-উবারের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা হোক। এফবিসিসিআই মনে করে ব্যাংকের মতো অন্য প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর আড়াই শতাংশ হ্রাস, আগের নিয়মেই পোশাক শিল্পের করপোরেট ট্যাক্স ও রফতানিকে উেস কর আরোপ, ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে ৩ লাখ টাকায় উন্নীতকরণ, আমদানিতে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার, আয়কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা হ্রাস, যানবাহনের লিফ স্প্রিংয়ের সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি, অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট আগের নিয়মে ৪ শতাংশ হারে আদায়, অ্যাপসভিত্তিক রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের (উবার, পাঠাও) ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি।

আমদানি শুল্ক সংক্রান্ত দাবিসমূহ পুনঃবিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে এফবিসিসিআই বলেছে, মুদ্রণশিল্পে আমদানিকৃত প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করছি। আমাদের মুদ্রণ শিল্প আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত হয়েছে।

করপোরেট কর কমানোর দাবি বিজিএমইএর : রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পে করপোরেট করহার বাড়ানোর ফলে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবেন বলে জানিয়েছে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। সংগঠনটি করপোরেট করহার কমানোর দাবি করেছে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন সংগঠনটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে পোশাকশিল্পের করপোরেট কর ১২ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ এবং সবুজ শিল্পের জন্য ১০ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ দাবি ছিল করপোরেট কর ১২ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার। এখানে আমরা অর্থমন্ত্রীর সুবিবেচনা চাই।’ তিনি উেস কর আগামী তিন বছরের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, বাজেট প্রস্তাবে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ৫৩ (বিবি) ধারায় রপ্তানির উেস কর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১ শতাংশ হারে নির্ধারিত হয়েছে। প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণায় উেস কর ১ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা হলেও পরে আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে তা কমিয়ে এনেছি। আবার রপ্তানি ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রত্যক্ষ রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে উেস কর কাটা হচ্ছে। সেইসঙ্গে একই রপ্তানি এলসির বিপরীতে প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকদের যেমন সুতা, কাপড়, এক্সেসরিজ সরবরাহকারীদের থেকেও একই হারে উেস কর কর্তন করা হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়।

বিজিএমইএ সভাপতি ভ্যাট প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিগত পাঁচ থেকে ছয় বছরের ভ্যাট মওকুফ করার জন্য যে দাবি করছি, সে ব্যাপারে ঘোষিত বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এমনকি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির ওপর প্রদত্ত মূসক প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে জটিলতা দূরীকরণের লক্ষ্যে শতভাগ মূসক অব্যাহতি প্রদান করার প্রস্তাবও রেখেছিলাম। কিন্তু সে ব্যাপারেও কোনো নির্দেশনা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছি। এজন্য সামনে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। ২০২৭ সালে এটি চূড়ান্তভাবে অর্জিত হলে আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে; যা মোকাবিলার জন্য ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। এটি সম্ভব হবে সহায়ক নীতি-কৌশলের মাধ্যমে। বাজেটে এ বিষয়টির ওপর আলাদাভাবে কোনো প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি।’

ব্যাংকিং খাতে সংস্কার চায় বিসিআই : প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সংস্কার কর্মসুচি প্রয়োজন বলে মনে করে শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ-বিসিআই। সংগঠনটি বলেছে, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা, বিনিয়োগের স্থবিরতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রস্তুতি সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গতকাল মতিঝিলের বিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত বাজেট আলোচনায় এ কথা বলেন সংগঠনটির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি বলেন, বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতা ও ভাতা বৃদ্ধি, পরিবহন ও যোগাযোগ, জ্বালানি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যা আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বিসিআই বলেছে, আমাদের রপ্তানি আয় ক্রমবর্ধিত হারে উন্নীত করার লক্ষ্যে রপ্তানি খাতের জন্য শুল্ক ও কর সুবিধা, আর্থিক সহায়তা ও বিভিন্ন রেয়াতি ব্যবস্থা প্রদানসহ সুনির্দিষ্ট রপ্তানি বাজেট প্রদানের জন্য বেসরকারি খাতের প্রস্তাব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ব্যাংকিং খাতে বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে : দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম। সংস্থাটি বলেছে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে বড় ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এই বিষয়গুলো যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় না আনা হলে এবং যথোপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে আগামীতে আরও সংকটময় সময় অপেক্ষা করছে। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত বাংলাদেশের অর্থনীতির ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা করতে গিয়ে এসব কথা বলেন সাউথ এশিয়ান ইকোনোমিক মডেলিং-সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তিনি প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে বলেন, এবারের বাজেটকে আমরা বলতে পারি এসডিজির মহাসড়কে না উঠতে পারার বাজেট। আমরা যদি প্রকৃৃত অর্থেই এসডিজি বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে বাজেট অবশ্যই এসডিজির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তিনি বলেন, ভ্যাট আইন ২০১৯ সাল নাগাদ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি। কর আদায়ে একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এ ক্ষেত্রে যে ‘র?্যাডিক্যাল ইমপ্রুভমেন্ট’ প্রয়োজন তা কিন্তু হয়নি। বরং কর কাঠামোতে যারা কর আদায় করেন, তাদের দক্ষতা বাড়াতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি।

সর্বশেষ খবর