শনিবার, ২৩ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

সারা দেশেই বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ

আবেদন বেশি নারীর, নেই কাউন্সিলিং

জিন্নাতুন নূর

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগেই অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকার মতো অন্যান্য বিভাগেও নারীরা বিচ্ছেদের আবেদন করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন। দেশের কয়েকটি সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রতি বছরই বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বিচ্ছেদ বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সন্দেহ, যৌতুক দাবি, সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, স্বামী-স্ত্রীর জীবন-যাপনে অমিল, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আরও বলেন, নারীর পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আগের চেয়ে বেশি সচেতন। নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর আপস করছেন না বরং অশান্তি এড়াতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে বিচ্ছেদের হার ছিল দশমিক ৬ জন, পরবর্তীতে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক ১ জন। বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের মধ্যে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন তাদের সংখ্যা বেশি (হাজারে এক দশমিক ৭ জন)। আর অশিক্ষিতদের মধ্যে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৫। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছেদের হার যেখানে হাজারে এক দশমিক ৩ শতাংশ আর শহরে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৮ জন। দেখা যায় যে, বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আবেদন করছেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, নৈতিক স্খলনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজে এখন বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালি, যাদের স্ত্রী তাদের থেকে দূরে থাকেন। তাদের ঘিরে এই প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়। একই সঙ্গে বাড়ে সন্দেহ প্রবণতা। যা পরবর্তীতে বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকাতেই গড়ে প্রতিদিন ৫০টির বেশি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে। সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বিচ্ছেদের নোটিস পাঠানো হয়েছে ২৪ হাজার ৯১২টি। এর মধ্যে পুরুষের পাঠানো নোটিসের সংখ্যা আট হাজার ৯৬টি এবং নারীর ১৬ হাজার ৮১৬টি। অর্থাৎ নারীরা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। ২০১৬ সালে রাজধানীর বাসিন্দাদের মোট চার হাজার ৮৪৭টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে পুরুষের এক হাজার ৪২১টি আর নারীর তিন হাজার ৪২৬টি। ঢাকার বাইরে বরিশাল বিভাগেও বর্তমানে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রেও আবেদনকারীদের মধ্যে এগিয়ে নারী। বরিশাল সিটি করপোরেশনের তথ্যে, ২০১৭ সালে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ১৩৮টি দম্পতির তালাক হয়। এর মধ্যে ৮৯ জন নারী বিচ্ছেদের আবেদন করেন। আর পুরুষদের মধ্যে বিচ্ছেদের আবেদন করেন ৪৯ জন। খুলনা মহানগরীতেও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে খুলনা মহানগরীতে মোট বিচ্ছেদ হয়েছে ছয় হাজার ৫৪৭টি। খুলনায় প্রতিবছরই বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেখানেও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে। অন্যান্য বিভাগের মতো চট্টগ্রামেও বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের হিড়িক পড়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যে, সেখানে এক হাজার ৫৭৯টি বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়। আর প্রতি মাসে গড়ে ৩৮৪টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে সেখানে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে বিচ্ছেদ ঘটছে ১৫টি আর প্রতি দুই ঘণ্টায় একটির বেশি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায়। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আর আবেদনকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহীতে। প্রতি হাজারে সেখানে এক দশমিক ৯ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। বিবিএসের হিসাব মতে, রাজশাহীর পর পরই সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হচ্ছে খুলনায়। সেখানে প্রতি হাজারে এক দশমিক ৩ জন বিচ্ছেদের আবেদন করছেন।  এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, ২০১৬-১৭ সালে মোট ৪৩৮ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। আর প্রতি মাসে গড়ে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে ২২ দম্পতি। এ হিসাবে প্রতিদিন সিলেটে ১টি দম্পতি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করে। রংপুরেও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের নারীরা বিচ্ছেদের আবেদন বেশি করছেন। এমনকি বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ময়মনসিংহেও। প্রতিদিন এই বিভাগে গড়ে ১৫টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে।

ময়মনসিংহ জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে ময়মনসিংহে আশঙ্কাজনকহারে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ সময় সেখানে বিবাহবিচ্ছেদ হয় মোট চার হাজার ৮০৮টি। ময়মনসিংহে প্রতি মাসে গড়ে বিচ্ছেদ হয় ৪০০টি। আর শহরাঞ্চলে এই বিচ্ছেদের হার আরও বেশি। এক্ষেত্রেও বিচ্ছেদের দিক দিয়ে এগিয়ে নারীরা।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বিচ্ছেদের ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পাওয়ায় শালিসি বোর্ডের কর্মকর্তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-১ এর কর্মকর্তারা জানান, সমাজের সব শ্রেণির নারীরাই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করছেন। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে আসক্ত নারীদের কেউ কেউ আবার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন। তারা বলেন, মাত্র ২ শতাংশ দম্পতি আমাদের কাছে শালিসি বৈঠকে আসেন। আর নারীদের তালাক দেওয়ার হার পুরুষের চেয়ে বেশি বলেও তারা স্বীকার করেন। তবে সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ বলেই বিচ্ছেদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে পর্যাপ্ত কাউন্সিলিংও হয় না বলে অভিযোগ আছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, একটি পরিবার ভেঙে গেলে শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সম্পর্কে ফাটল ধরে না, তাদের সন্তানদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।  রাজধানী ঢাকার নিকাহ রেজিস্ট্রাররা এই প্রতিবেদককে জানান, ঢাকায় প্রতি বছরই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শালিসের মাধ্যমে সংসার টিকছে এমন হার খুবই কম। নিয়ম অনুযায়ী কাজী অফিসে তালাকের আবেদন জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষকে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য বা সমঝোতার জন্য তিন মাস সময় দেয়। তালাকের আবেদন করা হলে শালিসের মাধ্যমে সংসার টিকছে এমন হারও কম। সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর দুই পক্ষকে প্রতি মাসে শুনানির জন্য ডাকা হলেও ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই এই শুনানির জন্য কোনো পক্ষই সিটি করপোরেশন অফিসে যায় না।

সর্বশেষ খবর