শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

মোবাইলে যাত্রা শুরু মৃত্যুতে শেষ

মির্জা মেহেদী তমাল

মোবাইলে যাত্রা শুরু মৃত্যুতে শেষ

মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে নূরি জান্নাত মিতু (২৬) খিলক্ষেত রেললাইন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় পেছন  থেকে আসা একটি ট্রেনের নিচে তিনি কাটা পড়েন। মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের গণিত বিভাগের ছাত্রী মিতু কমলাপুরগামী জামালপুর কমিউটার ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যান। এর একদিন আগে একইভাবে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে মালিবাগ লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট সালাহউদ্দিন আহমেদ ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন। কানে হেডফোন দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে  রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন রাজধানীর ধনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্র শাহিন। আশপাশের লোকজন অনেক ডাকাডাকির পরও তার মনোযোগ কাড়তে পারেনি কেউ। উদাসীন সেই শাহিন কখন যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তা বুঝতেই পারলেন না। চলন্ত ট্রেন যখন তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে  গেল তখন হয়তো বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু এখন আর বুঝেও কোনো লাভ হলো না শাহিনের। মুহূর্তের মধ্যে চলে গেল মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে! গেণ্ডারিয়া মুন্সীবাড়ির ঢালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন শাহিনের কাছাকাছি চলে এলে আশপাশের লোকজন তাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোনো কথাই সে শুনতে পায়নি। ততক্ষণে  ট্রেনটি তার ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে তার এক হাত দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি মারা যান। শুধু মিতু, শাহিন বা সালাউদ্দিন নয় অনেক মানুষের রেললাইনে ট্রেনে কাটা মৃত্যুর নপথ্যে এই মোবাইল ফোন।

 রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি মোবাইলে হেডফোন দিয়ে কথা বলার সময় অধিকাংশ রেললাইনে দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া রাজধানীর রেলপথে অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং রয়েছে যার কারণে কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৮ ও নারী ৪৪ জন। অপমৃত্য (ইউডি) মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা ২৮৫টি। ২০১৬ সাল রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৪ ও নারী ৬১ জন। ইউডি মামলাসহ মোট মামলা ৩০৫টি। সর্বশেষ চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৭০ জন। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারিতে ৩২ জন,  ফেব্রুয়ারিতে ২৫, মার্চে ২৩ ও এপ্রিলে ২২ জন মে মাসে ৩৬ এবং জুনে ৩২ জন মারা যান। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু  সেণ্ডারিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকায় রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০ জন। শুধু কমলাপুর থেকে কুড়িল ফ্লাইওভার পর্যন্ত অরক্ষিত রেলক্রসিং এবং উত্তরা এলাকায় মারা যান ১৬ জন। ২০১৭ সালে মৃতের সংখ্যা ৩ শতাধিক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, যখন  ট্রেন চলাচল করে তখন রেলওয়ের আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট লাইনের দুই পাশের ১০ ফুট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ট্রেন চলাচলের সময় রেলওয়ে আইন মানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তা তোয়াক্কা না করে হেডফোন কানে দিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলাচল করায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অসাবধানতাই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।

 রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগ ও রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা  গেছে, নারায়ণগঞ্জ-কমলাপুর-বিমানবন্দও রেলস্টেশন পর্যন্ত ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ২৩টি অবৈধ। এ ছাড়া এ  রেলপথে ছোট আকারের আরও প্রায় ৩০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ গেণ্ডরিয়া, মগবাজার, কুড়িল ও উত্তরার লেভেল ক্রসিং। সরেজমিন কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন রেলক্রসিং এলাকা ঘুরে  দেখা গেছে, লেভেল ক্রসিংটির দু’পাশে ‘এই রেলক্রসিং দিয়ে যানবাহন ও লোক পারাপার সম্পূর্ণ নিষেধ’ লেখা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের টানানো সাইনবোর্ড রয়েছে। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার করছেন পথচারীরা। জানা যায়, রাজধানী ও আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার  রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টির  কোনো অনুমোদন নেই। যেগুলোর একেকটি যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। মানিক নামে রেলগেটের এক কর্মচারী বলেন, দুই বছর আগে এ গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখানে কোনো ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করেনি। সিটি করপোরেশন কিংবা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেউ উদ্যোগ  নেয়নি। যে কারণে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছেন অনেকে।

উত্তরা হয়ে আসা রেলের লাইন প্রায় ৪০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাঁকা। অন্যদিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত লাইনটি প্রায় ৫০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাঁকা। যে কারণে ট্রেন এলেও কুড়িলের অবৈধ লেভেল ক্রসিং থেকে তা দেখা যায় না।

সর্বশেষ খবর