বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর ৬ খুনি এখনো অধরা

মির্জা মেহেদী তমাল

বঙ্গবন্ধুর ৬ খুনি এখনো অধরা

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ছয় খুনির মধ্যে দুজনের অবস্থান সম্পর্কে সরকার নিশ্চিত। বাকি চারজনের ব্যাপারে এখনো স্পষ্ট কোনো খবর নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনি নূর চৌধুরী আছেন কানাডায় ও রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে আলোচনা চলছে রাশেদকে ফেরত আনতে। লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে নূরের জন্যও। খুনি কর্নেল রশিদসহ চারজনের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য এসেছে সরকারের কাছে। তথ্য অনুযায়ী খন্দকার আবদুর রশিদ পাকিস্তান কিংবা লিবিয়ায়, শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান, আবদুল মাজেদ সেনেগালে ও মোসলেম উদ্দিন জার্মানিতে অবস্থান করছেন। এসব তথ্যের সত্যতা শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে পুলিশের কাছে এ-ও খবর রয়েছে যে, মোসলেম উদ্দিনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে জিম্বাবুয়েতে।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এটা খুব কঠিন হয়ে গেছে এখন। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এতটা কঠিন না হলেও, বেশি কঠিন হয়ে গেছে কানাডায় থাকা খুনিকে ফিরিয়ে আনতে। সে জন্য আমরা আলোচনা করছি। তবে তাদের কাছ থেকে আমরা নেগেটিভ কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। তারা আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাই এখনো আলোচনা চলছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডের রায় আংশিক কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে। সেই রাতে খুনি  সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করা হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে সাড়ে আট বছর। অথচ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা ছয় খুনিকে এখনো দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। সূত্র মতে, রায় কার্যকরের আগেই ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর খুনি আজিজ পাশা। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, পলাতক খুনিদের খোঁজে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা আছে। এর বাইরেও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো কাজ করে যাচ্ছে। কানাডায় আত্মগোপনে থাকা নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে লবিস্ট-আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ইন্টারপোলের রেড নোটিস বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। রেড নোটিসে বঙ্গবন্ধু খুনিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় উল্লেখ রয়েছে। পলাতকরা যেসব দেশে অবস্থান করছেন সেসব দেশ মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে। এই সুযোগটিও কাজে লাগাতে পারে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনিরা।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের অবস্থান চিহ্নিত করতে তাদের আত্মীয়স্বজনের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করছে সরকার। ভবিষ্যতেও ট্র্যাকিং অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে। খুনিরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য পলাতক নূর চৌধুরী কানাডায় আবেদন জানায়। তবে তা খারিজ হয়ে যায়। এরপরেও তাকে ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। সূত্র জানায়, নূর চৌধুরী ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে ১৯৭৬ সালে তিনি ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। সূত্র জানায়, খুনি রাশেদ চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী সেক্রামেন্টো থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরের শহর কনকর্ডে অবস্থান করছেন। তিনি ইতিমধ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। রাশেদ চৌধুরী ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনসুলেটে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি কেনিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করেন। ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে তাকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাকে ওই বছরের জুলাইয়ে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো চলে যান। আইনমন্ত্রী বলেন, কানাডায় একটি আইন আছে সেটা হলো, যদি কোনো দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তাহলে সে দেশের কোনো আসামিকে তারা ফেরত দেন না। সে জন্য আমরা একদিকে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি অপর দিকে সে দেশের সরকারকে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি যে নূর চৌধুরীর অপরাধ কতটা গুরুতর। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও কাজ করছেন। তবে যেহেতু তাদের দেশে একটি আইন আছে সেই আইন বহাল রেখেই তারা কীভাবে তাকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করতে পারে সেই প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করছি। আর যেহেতু তারা আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন তাই আমরাও আশাবাদী।

মহিউদ্দিন ও বজলুল হুদাকে যেভাবে দেশে ফেরত আনা হয় : বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মহিউদ্দিন ১৯৯৬ সালে ঢাকা থেকেই গ্রেফতার হন। অপরদিকে মধ্যপ্রাচের একটি দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করছিলেন মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মহিউদ্দিন ট্যুরিস্ট ভিসায় আমেরিকায় গিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে গিয়ে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু আমেরিকার একটি আদালত এ আবেদন নাকচ করে দিলে মহিউদ্দিন এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোর আদালত মহিউদ্দিনের পক্ষের সব আবেদনই নাকচ করে দেয়। এরই মধ্যে ২০০৭ সালের ১৩ মার্চ অভিবাসন আইন লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। একই বছর ১৮ জুলাই ইউএস হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসের দুই সদস্য মহিউদ্দিনকে থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছে দেয়। এর আগে একইভাবে ১৯৯৮ সালে ব্যাংকক থেকে ফিরিয়ে আনা হয় মেজর (অব.) বজলুল হুদাকে। একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চুরির অভিযোগে ব্যাংকক পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল।

সর্বশেষ খবর