শিরোনাম
শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়াই সচল ভুটান

শিমুল মাহমুদ, পারো (ভুটান) থেকে

ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়াই সচল ভুটান

কালো পিচের ওপর সাদা সরল রেখায় রাঙানো জেব্রা ক্রসিংয়ের কাছে এসে কেউ দাঁড়ালেই চলন্ত গাড়ি থেমে যায়। পথচারী পার না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি দাঁড়িয়েই থাকে। এগিয়ে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। অন্যকে আগে যাওয়ার ব্যবস্থা করায় কোনো বিরক্তি নেই। বরং ট্রাফিকশৃঙ্খলা বাস্তবায়নে ভুটানই বিশ্বের একমাত্র দেশ যাদের কোনো শহরে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। গত ছয় দিনের ভুটান ভ্রমণে কোনো ট্রাফিক পুলিশও চোখে পড়েনি। শুধু জেব্রা ক্রসিংনির্ভর ট্রাফিকব্যবস্থায় অভাবনীয় শৃঙ্খলার মধ্যে চলছে ভুটানের পরিবহনব্যবস্থা। কোথাও কোনো যানজট নেই। সড়ক দুর্ঘটনার হারও খুব কম। অথচ ভুটানের রাস্তা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। উঁচু অসংখ্য পাহাড়ের ওপর-নিচ দিয়ে তৈরি রাস্তায় সব সময় থাকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। ভুটানের ড্রাইভাররা দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়িয়ে এসব রাস্তায় গাড়ি চালান। অত্যন্ত ধীরস্থিও, বিনয়ী ড্রাইভারদের হাতে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা অনেক কম। শৃঙ্খলা ও আইন অনুসরণে ভুটানের ড্রাইভার ও নাগরিকরা এশিয়ার যে কোনো দেশের চেয়ে এগিয়ে। ভুটানে পাবলিক প্লেসে ধূমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও অ্যালকোহল বিক্রিতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। হোটেল, বার ছাড়াও প্রতিটি শহরে অসংখ্য দোকানে অ্যালকোহল বিক্রি হয়। দামেও অনেক সস্তা। এটি ভুটানের সংস্কৃতির অংশ। অ্যালকোহল ছাড়া তাদের অতিথি আপ্যায়নই সম্পূর্ণ হয় না। এজন্যই অ্যালকোহল পান শেষে ড্রাইভিং নিরুৎসাহিত করা হয়। সড়কের একটু পরপরই সতর্কবাণী লেখা রয়েছে, ‘ডোন্ট ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ড্রাইভ’। ভুটানে সড়ক দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশের তুলনায় এ সংখ্যা নগণ্য। পাহাড় থেকে গাড়ি নিচে গড়িয়ে পড়ে কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে প্রতি বছর। ভুটানের রাস্তা অত্যন্ত সংকীর্ণ হওয়ায় ড্রাইভাররা থেমে কিংবা পেছনে ব্যাক গিয়ারে গিয়ে অন্যকে যাওয়ার পথ করে দেন কোনো বাগিবতণ্ডা না করে কিংবা হর্ন না বাজিয়েই। যদিও এজন্য কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল বা ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশনা দিতে হয় না; কিন্তু রাজধানী ঢাকায় প্রশস্ত সড়ক সত্ত্বেও ডজন ডজন ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টের সামনেই বাসগুলো অসম প্রতিযোগিতায় রাস্তা বন্ধ করে সড়ক আটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের সৃষ্টি করে, ড্রাইভাররা পেছনে সরে গিয়ে অন্য কাউকে কখনো পথ দিতে চায় না।

বাংলাদেশে ফুটপাথে হাঁটার সিস্টেম নেই বললেই চলে। ফুটপাথে হাঁটার তেমন পরিবেশও নেই। ফলে সামান্য হাঁটাপথও মানুষ গাড়িতে চলাচল করে। অথচ ভুটানে শিক্ষার্থীরা ৫-৬ কিলোমিটার হেঁটে পাহাড়ি পথে তাদের স্কুলে যাওয়া-আসা করে। ফুটপাথগুলো প্রশস্ত ও উন্মুক্ত। কোথাও ফুটপাথ আঁকড়ে দোকান বা অন্য স্থাপনা বসানোর সুযোগ নেই। এক কাপ চা, কফি কিংবা একটি পান খেতে হলেও মার্কেটের নির্ধারিত দোকানে যেতে হবে। ঢাকার রাস্তায় যে ট্রাফিক নৈরাজ্য, অন্যকে পেছনে ফেলে আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা তা ভুটানে নেই। ফুটশোলিংয়ের ইমিগ্রেশন অফিসের সামনের সিগন্যালে এক সারি গাড়ির পেছনে কয়েকটি মোটরসাইকেল অপেক্ষায়। ডানে বাঁয়ে জায়গা ফাঁকা। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা নেই বাইকারদের মধ্যে। এখানে বাস ভাড়া অত্যন্ত সহনীয় এবং যাত্রার সময় খুবই যাত্রীবান্ধব। ৮টার বাস একদম ৮টায়ই ছাড়া হয়, যার টিকিটে লেখা থাকে রিপোর্টিং টাইম-৭:৪৫টা, লাগেজ গ্রহণ-৭:৩০টা এবং ছাড়ার টাইম-৮:০০টা। বাংলাদেশে এমন শৃঙ্খলা কল্পনাই করা যায় না। কোনো বাসই তার টাইমমতো কখনো ছাড়ে না। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহনে কবে শৃঙ্খলা ফিরবে কেউ বলতে পারে না। অথচ ছোট্ট দেশ ভুটান তা করে দেখিয়েছে। তাদের জনসংখ্যা মাত্র ৮ লাখ হলেও মানুষের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা কম নয়। সেই যানবাহনকে তারা অভাবনীয় শৃঙ্খলায় নিয়ে এসেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য যেমন এসেছে তেমনি যানজটমুক্ত, দুর্ঘটনামুক্ত পরিবহনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে।

সর্বশেষ খবর