রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঘরে বাইরে ওরা আতঙ্ক

মির্জা মেহেদী তমাল

ঘরে বাইরে ওরা আতঙ্ক

গ্রাম অঞ্চল বা শহরতলীতে কোনো বাচ্চার জন্ম হলেই হিজড়ার দল এসে ভিড় করে বলে ওঠে— ‘দে নারে তোর মণিটারে একটু নাচাই’ এই বলে নবজাতক কোলে করে নাচিয়ে বখশিশ নেয়। না দিতে চাইলে বাচ্চা নিয়ে তারা জিম্মি করে। মালিবাগ রেলগেট এলাকায় ৩তলা বাড়ির কেয়ারটেকার রাজিবের বাচ্চা নিয়ে টাকা আদায় করে হিজড়ার দল। মাসখানেক আগে তার ছেলে সন্তান জন্মেছে। খবর পেয়ে একদল হিজড়া তার বাসায় হাজির। তার সন্তান আরিফকে নাচাবে। এ জন্য ৫ হাজার টাকা দাবি করে। রাজিব বলেন, ৫ হাজার দিতে পারব না।  এতেই গালাগাল শুরু করে। এক পর্যায়ে তার ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে।

মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের কাছে একটি বাসার ৬ তলায় একদল হিজড়া চাঁদা আদায় করতে যায়। চাঁদার টাকা না পেয়ে তারা ওই বাড়ি ভাঙচুর করে। থানায় এ ব্যাপারে অবহিত করলেও তার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী আশরাফ। শ্যামপুরের চায়ের দোকানদার খলিল বলেন, কী বলব ভাই। হিজড়াদের টাকা না দিয়ে উপায় নেই। আগে ৫ টাকা দিলে নিত। এখন ১০ টাকার কমে নিতে চায় না। টাকা না দিলেই দোকানের কাস্টমারের সামনে কাপড় চোপড় খুলে ফেলে। মিরপুরের সিএনজিচালক আবদুল কুদ্দুস সালমান বলেন, তাদের টাকা দিতেই হবে। নইলে মান-সম্মান যাবে। অফিস, বাড়ি, গাড়ি, দোকানপাট, স্কুল, কলেজ কিংবা পার্ক। রাজধানীর সব জায়গাতেই চলছে হিজড়াদের ব্যাপক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ।

ইদানীং বাসে বাসে হিজড়ারা ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রাজধানীর প্রতিটি গণপরিবহনে দেখা যায় হিজড়াদের। দেখা যাচ্ছে তারা যাত্রীদের কাজ থেকে টাকা তুলছে। তারা এমনভাবে টাকা তুলছে মনে হয় যেন একপ্রকার হুমকি দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে। কোনো যাত্রী টাকা দিতে অস্বীকার করলে হিজড়ারা অশ্লীল কথা বলছে।

এমনকি গাড়ির ভিতরেই তারা তাদের গায়ের কাপড় খুলে ফেলছে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। তারা প্রতিটি যাত্রী থেকে ১০ টাকার নিচে নিচ্ছে না। টাকা না দেওয়ার কথা বললে তারা নানা হুমকি দিয়ে থাকে যাত্রীদের। গাড়ির মধ্যে যাত্রীদের তারা জড়িয়ে ধরছে, চুমু দিচ্ছে। টাকা তাদের দিতেই হবে। প্রয়োজনে তারা জোর করে তুলে নিবে। তবুও তাদের টাকা চাই। এ তো শুধু বাসের ভিতরের দৃশ্য। এ ছাড়া রিকশাযাত্রী, মোটরসাইকেল আরোহী কিংবা সিএনজি ও প্রাইভেটকারেও চলে সমানে চাঁদাবাজি। নিয়মিত চাঁদা না দিলে রাজধানীতে অফিসে বসতে পারেন না অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

আর পার্কে তরুণ-তরুণীদের একসঙ্গে পেলে তো হিজড়াদের পোয়াবারো। সেখানে রীতিমতো ছিনতাইকারীর ভূমিকায় লিপ্ত হয় তৃতীয় লিঙ্গের দাবিদার অধিকাংশ ভুয়া হিজড়ার দল। সব ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীিরব দর্শক। এমন পরিস্থিতিতে চরম অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। অনেকেই হিজড়াদের যন্ত্রণায় তিক্ত-বিরক্ত। কিন্তু প্রতিবাদ করারও সুযোগ নেই। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন যেমন নীরব, অন্যদিকে একশ্রেণির সমকামী গোষ্ঠী বিভিন্ন নামি-বেনামি এনজিওর মাধ্যমে উল্টো এদেরই শেল্টার দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, রাজধানীতে অন্তত ৬০ হাজার হিজড়া রয়েছে। যাদের অধিকাংশই ভুয়া। প্রকৃতপক্ষে তারা নারী বা পুরুষ। কারও কারও বাড়ি, স্ত্রী-সংসার রয়েছে। আবার কেউ কেউ সমকামী বলেই হিজড়া সেজেছে। এটা আয়-রোজগারের জন্য ভালো সুযোগ হওয়াতেই অনেকে লিঙ্গ কেটে হিজড়া সেজে চাঁদাবাজি করে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এমনো জানা গেছে, হিজড়ারা দিনের বেলায় চাঁদাবাজি করে। আর রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেহ ব্যবসায়ী সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে চলে তাদের ছিনতাই কার্যক্রম। রাজধানীর এক বাসযাত্রী বললেন, আমি উত্তরা থেকে আমার পরিবার নিয়ে মগবাজার সাতরাস্তা আসার জন্য বলাকা পরিবহনে উঠেছি। মহাখালী আসতে না আসতেই দুই-তিন হিজড়া এসে গাড়িতে হাজির। আমার কাছে টাকা চাইল। আমি ৫ টাকা দিয়ে থাকি তাদের। তারা ৫ টাকা তো নিলই না। আবার অশ্লীল আচরণ করল যা বলার বাইরে। পাশেই বসা ছিল আমার মেয়ে। আমি কি যে লজ্জা পেয়েছি। কবে যে এই হিজড়াদের থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি পাবে। রাস্তায় কর্তব্যরত এক পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে হিজড়ারা গণপরিবহনগুলোতে চাঁদাবাজি করছে, আপনারা কিছু বলেন না হিজড়াদের। তিনি বললেন, উপর মহল থেকে হিজড়াদের কিছু বলার কোনো আদেশ আসে নাই। যদি আসে তবে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিব। সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি হিজড়া রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ২ হাজারেরও বেশি। হিজড়াদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন স্থানে তারা হলো— ফার্মগেট, মগবাজার, গুলশান, মালিবাগের হায়দার ও স্বপ্না হিজড়া। উত্তরার নাজমা হিজড়া, সায়েদাবাদ, মতিঝিল এলাকার আবুল হিজড়া। পুরান ঢাকার দিপালী হিজড়া। লালবাগের রিনা হিজড়া। সাভার ধামরাই মনু হিজড়া। ডেমড়া, শ্যামপুর, ফতুল্লার লায়লা হিজড়া এমনকি শ্যামলি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এলাকার হামিদা হিজড়া। তারাই রাজধানীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তাদের এ সন্ত্রাসীমূলক কার্যক্রম ও চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি চাচ্ছেন রাজধানীর সাধারণ মানুষ।

পুলিশ বলছে হিজড়াদের উৎপাত দেখা দিলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর দায়িত্বে থাকা এসপি তবারক হোসেন বলেন, এই সেবায় কল করার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ এসে আক্রান্তকারীকে সাহায্য করবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর