সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গায়েবি তদবির

মির্জা মেহেদী তমাল

গায়েবি তদবির

পুরান ঢাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আকবর হোসেন তার মেয়ে লুসিকে (ছদ্মনাম) বিয়ে দেন একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই লুসির সাংসারিক জীবন ভালো যাচ্ছিল না। একটা ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে লুসির সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক খারাপ হয়। এ নিয়ে সব সময় লুসি মনমরা হয়ে থাকে। এ বিষয়টি খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করে লুসিদের গাড়িচালক ইদ্রিস।  সে লুসিকে পরামর্শ দেয় হুজুরের কাছে যেতে। তার পরিচিত একজন হুজুর আছেন, যিনি এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারেন। আপনার স্বামী আপনার বাধ্য থাকবেন। রামপুরা এলাকার এই মোতালেব হুজুরের গায়েবি তদবির ১০০ ভাগ ফলে যায় বলে বোঝায় লুসিকে। ইদ্রিসের এমন পরামর্শ শুনে লুসি যেন আলোর আশা দেখতে পেলেন। লুসি সেই হুজুরকে বাসায় নিয়ে আসতে ইদ্রিসকে অনুরোধ করেন। কিছুদিন পর লুসির অনুরোধে মোতালেব হুজুরকে বাসায় নিয়ে আসে ইদ্রিস।

সাদা ধবধবে আলখেল্লা আর পাগড়ি পরা একজন হুজুরকে নিয়ে আসে ইদ্রিস। লুসির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। হুজুরের কথা শুনে লুসি বিশ্বাস করতে থাকে। লুসি নিশ্চিত এবার তার সমস্যার সমাধান হবে। স্বামী তার কথামতোই চলবে।

মোতালেব হুজুর লুসির কাছ থেকে সব কিছু জেনে নেয়। তারা দুজন তাবিজ-কবজ নিয়ে কথা বলে। মোতালেব কথা বলেই বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে দেয়। এরপর একদিন মোতালেব হুজুর লুসিকে বলেন, তদবির করাতে ৫০ ভরি ওজনের ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে দুটি পুতুল তৈরি করতে হবে। একটি ছেলে পুতুল ও অন্যটি মেয়ে পুতুল। তাছাড়া এক ভরি ওজনের পাঁচটি তারকাঁটা (মোট পাঁচ ভরি), আট আনা ওজনের ১০টি স্বর্ণের কয়েন লাগবে। রাজি হয় লুসি। ইদ্রিস ও মোতালেবের কথায় বিশ্বাস করে ২১ লাখ টাকা খরচ করে তাঁতীবাজারে গিয়ে স্বর্ণ কিনে ওই জিনিসগুলো তৈরি করে লুসি। পরে ওই দুজনসহ বিল্লাল নামে আরেকজন কাঠের তৈরি একটি ছোট ঘর নিয়ে যায় লুসির বাসায়। মোতালেব লুসির বেডরুমে গিয়ে স্বর্ণের তৈরি জিনিসগুলো ওই কাঠের ঘরে সাজায়। পরে তদবিরের কথা বলে ওইদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে লুসিকে চিরতা পানি খাওয়ায়। এরপর লুসি অজ্ঞান হয়ে পড়লে তারা স্বর্ণের তৈরি ওইসব জিনিস, আলমারিতে থাকা একটি হার, একটি নেকলেস, দুটি কানের দুল, একটি টিকলি ও দুটি হাতের বালাসহ ৭৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায়।

বিষয়টি জানিয়ে গেন্ডারিয়া থানায় মামলা করে লুসি। গেন্ডারিয়া থানার পুলিশ জানায়, মামলার পর ওইদিন রাত ৯টার দিকে  কৌশলে মোতালেবকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হলে পুরো ঘটনা স্বীকার করে। নিজের প্রতারণার আরও কাহিনী পুলিশকে জানায় সে। পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মোতালেবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ইদ্রিস ও বিল্লালকে গ্রেফতার করা হয়। তিন দিনের রিমান্ড শেষে তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।  মোতালেব ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির ১০ লাখ তিন হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান ওসি কাজী মিজানুর রহমান। পুলিশ জানায়, হুজুরের ছদ্মবেশে একটি চক্র প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এভাবে। কখনো তদবিরের নাম করে, কখনো ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারের কথা বলে এ চক্রটি প্রতারণা করেছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশে নিয়ে গিয়েও মানুষকে প্রতারিত করেছে তারা। মোবাইল ফোনে ভুক্তভোগীরা প্রতারণার অর্থ ফেরত চাইলে তারা বলে, ‘আল্লাহর রাস্তায় আছি, চিল্লায় আছি’। প্রতারণার মাধ্যমে গত ৪-৫ বছরে  মোতালেব কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছে।

পুলিশ জানায়, এই চক্র একাধিক ব্যক্তির সর্বস্ব লুটে নিয়েছে।  যৌথ ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে খিলগাঁও থেকে রতন নামে একজনকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায় মোতালেব। মালয়েশিয়ার একটি হোটেলে দুজন এক সঙ্গে ওঠে। পরে রতনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ২০ লাখ টাকা নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দেয়  মোতালেব। চক্রটি রাজধানীসহ সারা দেশেই সক্রিয়। ইতিমধ্যে একাধিক ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মতিঝিল, রামপুরা, রমনা ও খিলগাঁও থানা এলাকায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর